সেবার দোলে নজরুল জেলে, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'বসন্ত'


বিক্রম পাঠক: দোল নয়, হোলি তো নয়ই রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন বসন্তোৎসব কথাটা। শান্তিনিকেতন নয়, এ একেবারে জোড়াসাঁকোর উত্তরাধিকার। ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা 'বালক'-এ সেবার রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদার লিখলেন গল্প। এই দোল নিয়েই কিন্তু সেখানে পিচকিরি ও রঙ বেলুনের কোনও উল্লেখ নেই। বরং সেখানে আবিরই প্রধান উপকরন। দোল কথাটা ব্যবহার হল না একবারও। ঠাকুরের কাছে দোল মানে কিন্তু রঙের বেলাল্লাপনা নয়। বরং সেটা অনেক বেশি স্নিগ্ধ। অনেক বেশি আগ্রহ সম্পন্ন। অনেক বেশি নৈস্বর্গিক

বছরটা ১৯২৩। দেশ তখন বিপ্লবের আগুনে পুড়ছে। আর বাংলা সেই বিদ্রোহের পূণ্যভূমি। এদিকে কবিতা লেখার অপরাধে জেলবন্দি হয়ে আছেন এক তরুণ কবি। তার নাম  নজরুল ইসলাম। 'ধূমকেতু' নামের এক পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাগুলিতে রয়েছে নাকি স্পষ্ট রাজদ্রোহের ইঙ্গিত। ১৯২৩ -এর জানুয়ারিতে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুমে তাই নজরুল এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হলেন। ফেব্রুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'বসন্ত'। এবং সেই বসন্ত গীতিনাট্যের উৎসর্গ পাতায় লেখা হল 

'শ্রীমান  কবি নজরুল ইসলাম / স্নেহভাজনেষু'

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন কোনও রাস্তাঘাটে রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজদের পদলেহক বলে অপমান করে তখন সত্যিই খুব কষ্ট হয়। জাতি, ধর্ম, সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে তাঁর মনে কীরকম ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা বোঝা যায় এই একটা ঘটনা থেকেই। সেদিনের সেই উৎসর্গপত্রের তারিখ ছিল ১০ই ফাল্গুন। ঠিক এর ৩দিন পরেই সে বছরের দোল যাত্রা। দোলের দিন কবি 'বসন্ত'র একটা প্রেসিডেন্সি জেলে নজরুলের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। নজরুল তৃপ্তির সঙ্গে পড়লেন সেই গীতিনাট্য। জেলের বাইরে থেকেও যেন দুই কবির প্রীতি-মিলন হয়ে গেল। রবীন্দ্র দূর থেকেই যেন নজরুলের জন্য বসন্ত গীতিনাট্যের রূপে এক মুঠো আবির পাঠিয়ে দিলেন এবং নজরুল সেটা গায়ে মেখেও নিলেন। 

সেদিন এই গীতিনাট্য জেলে নিয়ে যাওয়ার কাজটা করেছিলেন পবিত্র বন্দোপাধ্যায়। তাঁর হাতে বইটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘নজরুলকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’


              



নজরুল বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন, ‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা-ক্লেশ ভুলে যাই।’ নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্য গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। 

আজকের এই অশান্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে যেখানে হিন্দু-মুসলিম হানাহানি চলছে সেখানে এই গল্পটা সবারই জানা দরকার। বোঝা দরকার যে আমাদের ইতিহাস শুধুই ২টি জাতির যুদ্ধের নয়। সেখানে এমন বন্ধুত্বের নজিরও আছে।    
Blogger দ্বারা পরিচালিত.