ন্যাড়া পোড়ার নেপথ্যে রয়েছে কোন পৌরাণিক গল্প, বিজ্ঞানই বা কী বলে
আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল।
পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল॥'-
এই ছড়া বলতে বলতে দোলের আগমন ঘটে। তবে এই দোলের আগের দিন মহা সমারোহে পালিত হয় ন্যাড়া পোড়া। শুকনো পাতা, খড়, বাঁশের গায়ে নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয় ন্যাড়ার ঘর, তারপর বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সুপ্রাচীন এই আচার আম বাঙালির কাছে ন্যাড়া পোড়া নামে পরিচিত। তবে অবাঙালিদের কাছে এটি 'হোলিকা দহন' নামেই খ্যাত।
কিন্তু এই সুপ্রাচীন প্রথাটি কেন প্রচলিত হয়েছিল সেই পৌরাণিক কাহিনি অনেকেরই অজানা। রাক্ষসরাজ হিরণ্যকশিপ একবার তাঁর প্রজাদের পুজো করা বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি অমরত্ব লাভের আশায় ব্রহ্মার তপস্যা করা শুরু করেন। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে পাঁচটি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার আশীর্বাদ করেছিলেন। এই বিশেষ ক্ষমতার মধ্যে ছিল হিরন্যকশিপ-এর মৃত্যু দিনেরবেলাও হবে না, রাত্রিবেলাও হবে না। চারদেওয়ালের ভিতরেও হবে না, চারদেওয়ালের বাইরেও হবে না। কোনও মানুষের হাতেও হবে না, প্রাণীর হাতও হবে না। জলে-স্থলে মহাশূণ্যেও মৃত্যু হবে না। এমনকি অস্ত্রের সাহায্যেও হবে না, শস্ত্রের সাহায্যেও হবে না। অমরত্বের বরলাভ করে যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন হিরণ্যকশিপ। প্রজাদের ওপর আরও অত্যাচার শুরু করে। কিন্তু হিরম্যকশিপ-এর নিজের ছেলে প্রহ্লাদ তাঁর পিতাকে ঈশ্বর বলে মানতেন না। প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তাই রাগে নিজের ছেলেকেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন হিরণ্যকশিপ। আর এর জন্য হিরণ্যকশিপ তাঁর নিজের বোন রাক্ষসী হোলিকার সাহায্য নেন। প্রসঙ্গত হোলিকাও ব্রহ্মা দ্বারা বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে তিনি কখনওই আগুনে পুড়বেন না। তাই ভক্ত প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন হিরণ্যকশিপ। সেইমতো প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে বসেন হোলিকা। কিন্তু ভক্ত প্রহ্লাদের ভক্তিতে প্রসন্ন হন ভগবান বিষ্ণু। তাই তিনি প্রহ্লাদকে বাঁচিয়ে দেন। কিন্তু হোলিকা তার এই ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আর সেই থেকেই যা-কিছু অন্যায়, যা-কিছু খারাপ এই সবকিছুর অবসান হয়ে একদিন ন্যায়বিচারই প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই পুরাণের এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলিকা দহন উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
তবে পৌরাণিক তত্ত্বের পাশাপাশি এর নেপথ্যে কিন্তু একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। তা হল দোল বা হোলি উৎসব পালিত হয় বসন্তকালে। বসন্ত ঋতুর এক বিরাট পরিবর্তন অনুভূত হয়। এই সময় ঠান্ডা-গরম মিশিয়ে একটা মিশ্র আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। আর এই সময়েই যাবতীয় রোগ-জীবাণু-ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যার ফলে ফ্লু, ভাইরাসঘটিত জ্বর এবং পক্সের মতো একাধিক রোগ শরীরে বাসা বাধার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি বসন্তকালে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। আর সেইসব পাতা আবর্জনার রূপ নেয়। আর সেই কারণেই ঝরে যাওয়া শুকনো নারকেল পাতা, সুপুরির পাতা, খড় ইত্যাদি জড়ো করে তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে আগুনের সংস্পর্শে এসে জীবাণুও নষ্ট হয়, তাই এই প্রথাটি খুবই পরিবেশবান্ধব বলেই মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তাই আজও একইভাবে নিয়ম মেনে দোলপূর্ণিমার আগের রাতে পালিত হয় ন্যাড়া পোড়া বা হোলিকা দহন উৎসব।
Post a Comment