"শুভ হালখাতা", সকলের মিষ্টি খাওয়ার নিমন্ত্রণ রইলো !
Odd বাংলা ডেস্ক: পয়লা বৈশাখ, নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বাঙালির নতুন জীবন। আমাদের ছেলেবেলার মফস্বল শহরে পয়লা বৈশাখ আর হালখাতা ছিল অনেকটা যমজ ভাইবোনের মতো। হাত ধরাধরি করে হাজির হতো দুজনে বছরের প্রথম দিনটিতে। বাজারের প্রায় সব দোকানেই বাংলা বছরের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ হতো বেশ ঘটা করেই। এই দিন দোকানে অতিথি-অভ্যাগতদের মণ্ডা-মিঠাই দিয়ে আদর-আপ্যায়ন করা হতো। আর সেটিই ছিল আমাদের ছেলেবেলার পয়লা বৈশাখের বাড়তি আকর্ষণ। অভিভাবকদের হাত ধরে আমরাও মাঝেমধ্যে সেই নিমন্ত্রণে হাজির হয়েছি। বড়দের মতো আমাদের প্লেটেও দেওয়া হয়েছে রসে ডুবুডুবু ধবধবে সাদা বড় রাজভোগ, রসগোল্লা, কালোজাম, চমচম আর মিরিন্ডার কাঁচের বোতল স্ট্র সহ। সঙ্গে কালিজিরা ছিটানো হালকা গেরুয়া রঙের একখানা নিমকি। মচমচে ভাজা। সাথে এক গ্লাস পানি।
রাজভোগের মিষ্টতার বিলাসী আবেশের সঙ্গে নোনতা নিমকির নিরপেক্ষ স্বাদ এই দুই বিপরীত রসের স্রোতে রসনার তৃপ্তি হতে সময় লাগত না।
ছোটবেলায় বাবার সাথে হালখাতা খেতে যেতাম। খেতে যেতাম বলছি, কারণ খুব ছোটতে ভাবতাম হালখাতা মানে বোধয় মিষ্টি খাওয়া। মিষ্টি, দোকানের সাজগোজ সব মিলে ছেলেবেলাতে হালখাতা আমাকে টানতো, এখনো টানে তবে ডিজিটাল যুগে হালখাতার সেই আবহমানতা ফুটে উঠে কি না তা নিয়ে আমি বড়ই সন্দিহান। রঙিন কাগজের মালা, ফুল, জরির ঝালর দিয়ে সব দোকান সাজানো হতো। বাজারের একটা দোকানের সামনে কলাগাছের গেট তৈরি করে দেবদারু পাতা দিয়ে ছাওয়া হতো। তারই মাঝখানে রঙিন অক্ষরে লেখা ‘শুভ হালখাতা’। তারপর বাবার সাথে ঢুকে পড়তাম হালখাতার দোকানে। দোকানদার খুব আদর করে বসতে দিতেন। প্লেটভর্তি মিষ্টি এনে সামনে ধরে দিতেন। এত মিষ্টি খেতে যদিও পারতাম না, তবুও মিষ্টি দেখে চক্ষু হতো ছানাবড়া। জিভে আস্ত জল। দেনা পাওনা মিটিয়ে বাবা বলতেন "মেয়ে হালখাতা চেনে না, বুঝেছ। হা হা করে খানিক হেসে আমাকে বলতেন —মা এর নামই হালখাতা। খাও, মিষ্টি খাও। এর পরও দোকান থেকে ওঠার সময় আরও এক প্যাকেট মিষ্টি ধরিয়ে দিতেন দোকানদার। বৈশাখী মেলা থেকে নানা রকম খেলনা, বাঁশি, বেলুন কিনে বাবা আর আমার দুজনেরই হাত ভর্তি। তবু দোকানদার নাছোড়। হালখাতার মিষ্টি না নিলে তার দোকানের অকল্যাণ হবে। অতিথি দোকানে বসে খাবে, আর বাড়ির লোকেরা খাবে না, তাই হয়! বাঙালি হচ্ছে অতিথিপরায়ণ জাতি। অতিথিকে খাইয়ে-পরিয়ে আশ মেটে না।
তারপর বেশ বড় হবার পর বুঝলাম, "হালখাতা" জিনিষটা কি আসলে !
’হালখাতা শব্দটি বাংলা ভাষার অতিথি, আরবি-ফারসি জাত। জমিদারি আমলে ‘হালখাতা’ বৈভবের চূড়ান্তে পৌঁছেছিল।হালখাতা নতুন বাংলা বছরের হিসাব টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের অর্থাৎ দেশীয় ধরনের যাঁরা ব্যবসার হিসাব রাখেন, তাঁদের নতুন খাতা খোলায় এক আনুষ্ঠানিক উৎসব। পয়লা বৈশাখের এই অনুষ্ঠানটি এখন বেশ কিছুটা কমে গেছে। তবু হালখাতা এখনো যথারীতি খোলা হয়।
‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো করে এভাবে না ভাবলেও নতুন বছরে পুরনো দিনের হিসাব শেষ করতে চান ব্যবসায়ীরা। গত বছরের সকল দেনা-পাওনা চুকিয়ে নতুন বছর থেকে হিসাবের নতুন খাতা খোলেন তারা। এতে ব্যবসায়ীরা তাদের লেনদেন, বাকি বকেয়া, সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখেন। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে যারা ব্যবসায়ীদের নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থী, তাদের চিঠি দিয় বৈশাখের প্রথম দিন গ্রামবাংলা-শহরে ছোট-মাঝারি-বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করা হতো।
এ উপলক্ষে ছাপানো হতো নিমন্ত্রণপত্র। মুসলমানদের নিমন্ত্রণপত্রে থাকত মসজিদের মিনারের ছবি, আর হিন্দুদের কার্ডে মাটির পাত্রে কলাগাছের পাতা, ডাব এবং উপরে দেবতা গণেশের ছবি।
হালখাতার এ রেওয়াজটি সময়ের বিবর্তনে প্রায় হারিয়ে গেছে। বাংলা নববর্ষের দিনটিতে হালখাতার আয়োজন এখন তেমন চোখে পড়ে না, তবুও শুনেছি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা হালখাতার এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। চিঠি বা লোক মারফত আমন্ত্রণ জানিয়ে এখনো জলযোগে আপ্যায়ন করা হয়। এই দিনটিতে কেনাবেচার চেয়ে সামাজিকতা ও সৌজন্য বিনিময় হয় বেশি। তবে মনন সৌজন্যমূলক হলেও এ সুযোগে অনেকে তাদের বকেয়াও শোধ করে দেন।
হালখাতার অনুষ্ঠানটি অবশ্যই পয়লা বৈশাখে প্রতিপালিত হতে হবে। সেদিন যে নতুন খাতার সূচনা হয়, তা অন্য দিনে চলে না।
ব্যাপারটি সাংবাৎসরিক হিসাব রাখার বিষয় বলে তার ব্যবস্থা বাধ্য হয়েই নির্দিষ্ট দিনেই করতে হয়। হালখাতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো সম্বন্ধ নেই, যদিও হালখাতার মাথায় একটা স্বস্তিবচন লেখা থাকে। মুসলিম ব্যবসায়ী হলে তাঁর হালখাতায় ‘এলাহি ভরসা’ অথবা হিন্দু ব্যবসায়ী হলে ‘গণেশায় নমঃ’ লেখা থাকতে পারে।
ঐতিহ্যগতভাবে আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে সর্বত্র ইংরেজি মাসের হিসাব-নিকাশ প্রচলিত হওয়ায় হালখাতার উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এখন আগের মতো ঘটা করে হালখাতা পালন করা হয় না। তবে পহেলা বৈশাখের আগে দোকানগুলো ধোয়া-মোছা এবং পহেলা বৈশাখের দিনে মিষ্টি খাওয়া ও নতুন হিসাবের খাতা খোলার রেওয়াজ এখনও চালু আছে।
পয়লা বৈশাখ—নববর্ষের উৎসব, যা আমাদের সমাজজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্মল, ভেদবুদ্ধিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নতুন বছর সকলের মিষ্টি মধুর হয়ে উঠুক l হালখাতা খেতে যেতে পারি কি না পারি নববর্ষে মুখ মিষ্টি করতে দোষ কি ! বছরের শুরুটা যদি মিষ্টিমুখ দিয়ে শুরু না হয় তাহলে কি জমে নাকি বলুন l আজকে সকালে আজকের ডিল ঘাটতে গিয়ে চোখে পড়ল "হালখাতার মিষ্টি" নামের ক্যাটাগরি আর আমি হয়ে গেলাম নস্টালজিক, আর তারই ফল স্বরূপ এই লেখাটি l "শুভ হালখাতা", সকলের মিষ্টি খাওয়ার নিমন্ত্রণ রইলো !
Post a Comment