ভালবাসার গল্প: মুনলাইট সোনাটা



শুভেন্দু পাঠক: বিক্রমের বেশ মনে আছে, কলেজের দিনগুলোতে সুরভি তাঁকে নিয়ে কি পাগলামিটাই না করত। এমন কি একবার তো অনিন্দিতার সঙ্গে সে-কি ঝামেলা সুরভির। কারণ বিক্রমের জামার হাতা গুটিয়ে দিয়েছিল অনিন্দিতা। অন্যের প্রেমিকের প্রতি তাঁর এত কেন কেয়ার বুঝতে পারেনি সুরভি। বিক্রম শুধুই তাঁর ব্যক্তিগত। তার কালো চুল, চোখের পাতা সবই শুধুই সুরভির, বিক্রমের ঠোঁটটা নাকি কিছুটা মেয়েদের মতো। সাধারণত পুরুষদের ঠোঁট এত সুন্দর করে ঈশ্বর বানায় না, মনে করে সুরভি। আর সেই সুরভিই এখন বিক্রমের স্ত্রী। এখনও বিক্রমের চেহারাটা অনেকটা একইরকম আছে। বিক্রম এখন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। তাই সারাদিন নিজের স্টাডি রুমে বসে গল্প-উপন্যাস লিখেই কেটে যায় তাঁর। অনেক কাজ আছে এখন বিক্রমের হাতে। প্রচুর ডিজিটাল ও মুদ্রিত পত্রিকার ডাকে সে গল্প, কবিতা ও উপন্যাস লিখে থাকে। তাই বসে বসে ওজনটা একটু বেড়েছে। গ্রামের ছেলে বিক্রম এখন বেশ শহুরে। কলকাতার পার্কস্ট্রিটে ফ্ল্যাট কিনেছে। বিরাট পৈতৃক সম্পত্তির জোরে এখন সে কোটিপতি। 



 আজ সকাল থেকে শহর জুড়ে খুব বৃষ্টি নেমেছে। এই ফ্ল্যাটের জানলার বাইরেটাও ঝাপসা হয়ে আছে। বিক্রমের ইচ্ছে করল ড্রয়িং-এ রাখা পিয়ানোটা একটু বাজাতে। সে জানলার পর্দাটা সরিয়ে বৃষ্টি ভেজা কাঁচের দিকে তাকিয়েই পিয়ানোটা বাজাতে শুরু করে। আজ বিথোভেনের মুনলাইট সোনাটা বাজাচ্ছে বিক্রম। বারোশো স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাটের চারিদিক ভরে যাচ্ছে পিয়ানোর আওয়াজে। বিক্রমের পিয়ানো বাজানো আসলে তাঁর মন খারাপের বহিঃপ্রকাশ। বিক্রম পিয়ানো বাজাতে বাজাতেই একবার কাঁচের জানলাটার দিকে তাকায়। আর তখনই তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সামনের ফ্ল্যাটে এক নারী তাঁর বাজানো পিয়ানোর সুরধ্বনি মন দিয়ে শুনছে। জানলা দিয়ে তাঁর ড্রয়িং রুমটা বেশ দেখতে পাচ্ছে বিক্রম। মহিলাটি পরেনে কেবলই অন্তর্বাস। সোফায় গা এলিয়ে বিক্রমের বাজানো মুনলাইট সোনাটাকে উপভোগ করছেন তিনি। হাতে একটা ওয়াইনের গ্লাস। খুব রোগা নয় পেটের কাছে হালকা মেদ আছে। খানিকটা পুরুষোচিত স্বভাবের বশেই মহিলার বুকের দিকে চোখ চলে যায় বিক্রমের। অন্তর্বাসের মধ্যেই বিক্রম যেন তাঁর ভেতরের দৃশ্যটাকে দেখতে পায়। মহিলা বাঙালি। পার্কস্ট্রিটের এই এলাকাতে অবাঙালিরা সংখ্যায় বেশি। কিন্তু ড্রয়িং রুমের একটা দেওয়ালে বিভূতিভূষণের একটা ছবি টাঙানো। অবাঙালিরা রবীন্দ্রনাথের ছবি টাঙিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু বিভূতিভূষণের ছবি একজন মারওয়াড়ি বা গুজরাটি টাঙাবে বিশ্বাস করা অসম্ভব। আচমকা পিয়ানোর একটা ভুল ‘কি’-তে আঙুল পড়ে যায় বিক্রমের। সেই মহিলারও যেন ধ্যান ভঙ্গের মতো অবস্থা। চোখ খুলে তাকায় সে। বিক্রমের চোখে চোখ পড়ে যায় মহিলার। একজন অর্ধনগ্ন নারী বিক্রমের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। বিক্রম মুখটা ঘুরিয়ে পিয়ানোর দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁর আঙুলগুলো কেঁপে ওঠে। বিক্রম আবার পিয়ানো বাজাতে শুরু করে। এবার যেন মুনলাইট সোনাটার টেম্পোটা একটু বেড়ে গিয়েছে। বুকের ভেতরটা কেমন একটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। সুরভি বাড়িতে নেই। এটা ভেবে নিজের লাম্পট্যের কথা চিন্তা করে বিক্রম। নতুন নারীদেহে বিক্রম বেশি কিছু পাবে নাকি? স্পেশাল কিছু? বিক্রম আপন মনেই আর একবার তাকায় জানলার বাইরে। কিন্তু কোথায় কে? ওই ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুম তো ফাঁকা। 



বিক্রম বাজিয়ে চলেছে তাঁর পিয়ানো। একবার মনে করার চেষ্টা করল মহিলাটির অবয়ব। বিক্রমের চোখ খুব তীক্ষ্ণ। সেটা সুরভিও স্বীকার করে। সে খেয়াল করেছে কাঁচের জানলা দিয়েই। মহিলাটির ক্লিভেজের ওপরে একটা তিল আছে। থাইয়ের কাছে খুব অল্প স্ট্রেচ মার্ক। বিয়ে হয়তো হয়নি, আবার হতেও পারে। কারণ এখন তো অনেকেই বিয়ের পর শাঁখা-সিঁদুর পরেননা। সুরভিও পরে না। সে মনে করে ব্যাপারটা আসলে মেয়েদের ছোটো করার একটা চক্রান্ত। শাঁখা-সিঁদুর পরা মানেই নাকি কারও মালিকানাধিন হয়ে থাকা। বিক্রম অবশ্য কখনও এটা নিয়ে সুরভির সঙ্গে আলোচনা করেনি। শুধু চুপচাপ সুরভির কথা শুনেছে। হঠাৎ দরজার কলিং বেলটা বেজে ওঠে। বিক্রমের আচ্ছন্নতা কেটে যায়। এগিয়ে যায় সে দরজার দিকে। ডোর ভিউয়ারে চোখ লাগিয়ে চমকে ওঠে সে। বাইরে সামনের ফ্ল্যাটের সেই মহিলাটি দাঁড়িয়ে। সে এখানে কেন এসেছে? চিন্তা করে বিক্রম। মহিলা আরও একবার কলিং বেলটা বাজিয়ে দেয়। বিক্রম মন্ত্র মুগ্ধের মতোই দরজাটা খুলে দেয়। মিসেস রায় আছেন? শুনতে পায় না বিক্রম। আবার জিজ্ঞাসা করে মহিলাটি। বলছি মিসেস রায় বাড়িতে নেই? বিক্রম মাথা নাড়িয়ে বলে না। মহিলাটি একটা লাল শাড়ি পরে এসেছে। বিক্রমের মনে আছে তাঁর জীবনের প্রথম যে নারীর সঙ্গে তাঁর যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, সেও ঠিক এই রকমই একটা লাল শাড়ি পরেছিল। তখন সে এবং সেই মেয়েটি ক্লাস ইলেভেনে পড়ত। সরস্বতী পুজোর দিন বিক্রম তাঁদের গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা না থাকার সুযোগে ওই মেয়েটির সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। বিক্রম কি মেয়েটাকে ভালোবাসতো? বিক্রম নিজেই যেন উত্তর দেয়, ভালোবাসা ছাড়া কারও শরীরকে আপন করা যায় কি? তারপর সে শহরে চলে আসে পড়াশোনা করতে। সুরভির সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। শুনেছে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর সুরভীর নেশায় বিক্রমও বুঁদ হয়ে আছে এখন। তাঁর মনে পড়ে যায় ফুলশয্যার রাতে বিক্রম সুরভীকে একটা লাল শাড়ি পরতে বলেছিল। কিন্তু সুরভি তাঁর জেদ বজায় রেখে একটা গোলাপী শাড়ি পরেছিল। আজ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি ওই রকমই একটা লাল শাড়ি পরেছে। একটু জল দেবেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি, লিফ্টটা চলছে না। বিক্রম একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে জল আনতে চলে যায়। রান্নাঘরে রাখা অ্যাকোয়াগার্ডের নিচে গ্লাসটাকে ধরেছে সে। জলটা খুব আস্তে করে পড়ে এই অ্যাকোয়াগার্ড থেকে। মহিলাটি সত্যিই খুব সুন্দরী। কোমড়ের কাছটা বেশ ভাঁজ হয়ে আছে। শাড়িটা সিল্কের, তাই দেহের আকারটা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে। ক্লিভেজের যে তিলটা বিক্রম সেটা কালো নয় লাল। গলায় একটা পেন্ডেন্ট আছে। নাকে নোজপিন পরেছে! শহুরে হয়েও এই জিনিসকে বিক্রমের বেশ গ্রামীন লাগে। কানে দুল ও নাকে নোলক থাকলে মেয়েদের চেহারায় একটা স্নিগ্ধতা আসে। ঠোঁটে চুম্বনের সময় তাঁর নিজের নাকটি ওই নাকের নোলকে গিয়ে ধাক্কা খাবে। গ্লাসে জল ভরে গিয়েছে। অ্যাকোয়াগার্ড বন্ধ করে দেয় বিক্রম। ড্রয়িং রুমে ফিরে এসে বিক্রম একটু অবাক হয়। মহিলাটি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এসেছে। সোফাতে এসে বসেছে। ব্যাপারটাকে বিক্রম অসভ্যতা বলেই মনে করে। বলা নেই কওয়া নেই ঘরের ভেতর ঢুকে এসেছে!বিক্রম জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় মহিলার দিকে। দরজাটা এখনও খোলা। মহিলা জলটা খেয়ে নিয়ে বিক্রমকে বলে, ‘স্যরি! হাঁফিয়ে গিয়েছিলাম তাই আপনাকে না জিজ্ঞাসা করেই সোফাটাতে এসে বসেছি।’ ভদ্রতার খাতিরে বিক্রম একটু হেসে বলে, ‘না! না! ঠিকাছে। মহিলাটিও মুচকি হাসে। বিক্রম এরপর কি বলবে বুঝতে না পেরে একটু গাল চুলকোতে যায়। মহিলাটি বলে ওঠে, ‘মিসেস রায় আমাকে চেনেন। আপনাদের সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলাম। শুনছি আপনি নাকি খুব ট্যালেন্টেড একজন মানুষ? আপনার লেখা পড়েছি তবে পিয়ানোটা আজ শুনলাম।’ বিক্রম ভাবে মহিলা কি কোনওভাবে তাঁকে মনে করাতে চাইছে যে সে তাঁকে অর্ধনগ্ন দেখেছে। বিক্রমের কি সেটা অপরাধ হয়েছে! সে তো নিজেই জামা-কাপড় খুলে বসেছিল। জানলার পর্দাটাও খোলা ছিল। ফলে তাঁর চোখ পড়ে গিয়েছে। মহিলার মুখের দিকে তাকায় বিক্রম। ঠোঁটটাতে একটু ম্যাট লিপস্টিকের ছোঁয়া আছে। 



ভালো করে দেখলে বোঝা যায়। কাজল দিয়ে চোখটাও আঁকা বেশ অন্যরকম। মহিলাটি বলে ওঠে, ‘মিসেস রায় এসে দেখলে ভাববেন, একা ঘরে আপনি আবার উটকো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছেন। বিক্রম এখন মহিলাটির পাশে এসে বসেছে সোফাতে। মহিলাটির কথাবার্তাগুলো কি অসংলগ্ন!এবার বিক্রমের হাতটা ধরে মহিলা বলে, ‘জানেন আমার খুব বিপদ। আমাকে আপনি একটু আগলে রাখতে পারবেন? বিক্রম হাতটা ছাড়াতে চায়। মেয়েটির গা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। বিক্রমের হাতটা টেনে নিজের দিকে এগিয়ে এনেছেন তিনি। দরজাটা তখনও খোলা। মহিলা ধীরে ধীরে বিক্রমের কাছে আসছে। একটু একটু করে বিক্রমের সমস্ত শরীরে স্পর্শ করছে সে। বিক্রম ভাবে যদি কিছু করতেই হয় তাহলে দরজাটা লাগিয়ে ফেলা উচিত। কিন্তু না, বহু চেষ্টা করেও তার দিকে নিজেকে আকৃষ্ট করতে পারছে না বিক্রম। মহিলাটি যতবারই তাকে নিজের শরীর দিয়ে বেঁধে ফেলতে চায়, ততই দূরে পালায় বিক্রম। আচমকা কলিং বেলটা আবার বেজে ওঠে। এ কি! দরজাটা লক করল কে? বিক্রম ফিরে তাকায়। দৌড়ে যায় দরজার দিকে। ডোর ভিউয়ারে চোখ দিয়ে দেখে বাইরে সুরভি দাঁড়িয়ে। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। সে সিঁড়ির আলোটাও জ্বালাতে ভুলে গিয়েছে। বিক্রম ফিরে তাকায় সোফার দিকে। আশ্চর্য্য! মহিলাটি কোথায়! ঘরের কোনও কোণাতেই নেই সে। ঝোঁকের বশে দরজা খুলে দেয় বিক্রম। সুরভী ঘরে ঢুকে আসে। সুরভি আজ অনেকটা মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছে। বিক্রমের সঙ্গে শেষ কবে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয়েছে সুরভি… মনে পড়ে না। বিক্রমকে আর বোধহয় সুন্দর মনে করে না সুরভি। বাইরে অন্য কারও সঙ্গে শুয়ে সুরভি বাড়ি ফেরে কিনা, কোনওদিন জানার চেষ্টা করেনি বিক্রম। তবে সে এখন অনেক পার্টি করে। রাত করে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে। বিক্রমের প্রতি তার কোনো আকর্ষন নেই। তাই প্রত্যেকদিন নিজের কল্পনা শক্তি দিয়ে একজন কাল্পনিক নারীকে বিক্রম নিজের ড্রয়িং রুমে আসতে দেয় এবং প্রত্যাখ্যান করে, একবার দু-বার নয়, বারবার প্রত্যাখ্যান করে। ঠিক যেভাবে গত কয়েক বছর ধরেই প্রতি রাতে সুরভির কাছে প্রত্যাখ্যাত হয় বিক্রম।

[এই গল্পের স্বত্ব oddbangla.com -এর। কপিরাইট ( Copyright Disclaimer Under Section 107 of the Copyright Act 1976) নিয়ম মোতাবেক বিনা অনুমতিতে এর ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ]

পরিবেশক: oddbangla.com 

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করন: Uro Digi Art
Blogger দ্বারা পরিচালিত.