সালটা ১৭৩৭, সেবার সুপার সাইক্লোনে বাবুঘাটের লঞ্চগুলো বড়বাজারে উঠে এসেছিল



Odd বাংলা ডেস্ক: সুপার সাইক্লোন আম্ফানের তাণ্ডবে 'সিটি অফ জয়' কলকাতা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড় সব তছনছ করে দিয়েছে। কতটা ক্ষতি হয়েছে তা এখনো কল্পনাতীত। বিধ্বংসী আম্ফান আলোচনায় ফিরিয়ে এনেছে আঠারো ও উনিশ শতকের দু’টি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়কে। ১৭৩৭ এবং ১৮৬৪, দু’বারই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হয়েছিল বাংলা-সহ আজকের কলকাতা। বিদেশি ঔপনিবেশিকদের কলমে নথিবদ্ধ আছে সেই দু’দিনের ভয়াল অভিজ্ঞতা। ইউরোপীয় অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়ের পরে বাংলায় পা পড়েছিল ব্রিটিশদের।



 সে সময় শ্রীরামপুর, ফরাসডাঙা-সহ হুগলির বিভিন্ন জায়গা কলকাতার তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ। সেখানে ব্যবসা করে সুবিধে করতে পারলেন না ব্রিটিশরা। জোব চার্নকের পছন্দ হল হুগলি নদীর তীরে জঙ্গলে ঢাকা এলাকাই। গোবিন্দপুর-সুতানটি-কলকাতা নিয়ে নতুন শহরের জন্ম নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। ১৬৮০ থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মকর্তা মোতায়েন ছিলেন কলকাতার কুঠি সামলানোর জন্য। সে রকমই এক জন কর্মকর্তা জন স্ট্যাকহাউস। তিনি কলকাতার দায়িত্বে ছিলেন ১৭৩২ থেকে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দ অবধি। তার আমলেই তৎকালীন বাংলা কেঁপে উঠেছিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে। ঐতিহাসিক নথিতে যার পরিচয় ‘১৭৩৭ বেঙ্গল সাইক্লোন’নামে।



বাংলায় আশ্বিনের ঝড় যে সময়ে দেখা যায়, সে রকম সময়েই, ১৭৩৭-এর ১১ অক্টোবর সকালে ধেয়ে এসেছিল বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়। ৬ ঘণ্টা ধরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩৮১ মিলিমিটার। ৩৩০ কিমি এলাকা বিধ্বস্ত হয়েছিল ঝড়ের তাণ্ডবলীলায়। আজ যেখানে মহাকরণ, সেখানে ছিল সেন্ট অ্যানের গির্জা। ইংরেজদের তৈরি সেই আদি উপাসনাস্থল চুরমার হয়ে ভেঙে পড়েছিল। কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল কুমোরটুলির গোবিন্দরামের মন্দিরের মূল পঞ্চরত্ন চূড়া। দাপুটে গোবিন্দরাম ছিলেন সে কালের এক ধনকুবের। 



তার তৈরি মন্দিরের আর এক নাম ছিল ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’। শোনা যায়, উচ্চতায় তা ছিল অক্টারলোনি সৌধের থেকেও দীর্ঘ। গঙ্গার তীব্র জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় গঙ্গার ঘাটগুলি। দেশীয় ডিঙি নৌকোর পাশাপাশি উধাও বিদেশি বণিকদের জাহাজও। ঝড়ের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে শোনা যায়, গঙ্গা থেকে একটি বজরা এসে আটকে যায় আজকের ক্রিক রো-র জায়গায় থাকা খাঁড়িতে। এর থেকেই এলাকার নাম ডিঙাভাঙা লেন। আঠারো শতকে ব্রিটিশদের তৈরি কলকাতার মানচিত্রে এই অঞ্চলকে ‘ডিঙাভাঙা’ হিসেবেই দেখানো হয়েছে।



এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দু’টি পরিবর্তন হয়েছিল। প্রথমত, প্রাচীন খাঁড়ি হারিয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, এলাকাটি নতুন নাম পেল। তবে পরবর্তীকালে খাঁড়ি বোজানোর কাজে মানুষেরও যথেষ্ট অবদান ছিল বলে মনে করা হয়। খাঁড়ি হারিয়ে গেলেও তার অস্তিত্ব রয়ে গেল এলাকার ‘ডিঙাভাঙা’ এবং পরে ‘ক্রিক রো’ নামে। কলকাতার ইতিহাসে আরও একটি খালের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার নাম ‘বৌরানি খাল’। অনেকের মত, ডিঙাভাঙার খাঁড়িকেই সংস্কার করেছিল ব্রিটিশরা। তার পর তার নাম হয়েছিল ‘বৌরানি খাল’। ব্রিটিশ নথি অনুযায়ী, সে দিনের ঝড়ে শুধু সাবেক শহরাঞ্চলেই প্রাণ হারিয়েছিলেন তিন হাজার মানুষ। গঙ্গায় মাঝিমাল্লা-সহ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল অন্তত আটটি নৌকা। পাওয়া যায়নি ওলন্দাজদের তিনটি জাহাজও। সারা বাংলায় সে দিনের ঝড়ে ডিঙি নৌকো থেকে জাহাজ মিলিয়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল কমপক্ষে ২০ হাজার জলযান। প্রাণ হারিয়েছিলেন তিন লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ মানুষ। ইতিহাসবিদ রঞ্জন চক্রবর্তীর গবেষণায় ১৭৩৭ সালের ওই ঘূর্ণিঝড়ের বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণ রয়েছে। বিলেতের ‘জেন্টলম্যানস’ পত্রিকাতেও সে সময় এই বিপর্যয়ের সবিস্তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ভূতত্ত্ববিদ রজার বিলহ্যামের গবেষণাতেও সেই রিপোর্টের উল্লেখ রয়েছে।



১৭৩৭ সালের ওই বিপর্যয় কি নেহাতই ঘূর্ণিঝড়, নাকি ভূমিকম্প ও তার ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ আবার দু’টি কারণের কথাও বলেন। তবে সেটা ঘূর্ণিঝড় না কি ভূমিকম্পের ফলে জলোচ্ছ্বাস, তা নিয়েও বিজ্ঞানীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন। ভূমিকম্প নিয়ে কোনো প্রামাণ্য তথ্য তৎকালীন কোনো নথিপত্রে নেই। ফলে বেশির ভাগ বিজ্ঞানী ওই বিপর্যয়ের পিছনে ঘূর্ণিঝড়ই দায়ী বলে মনে করেন। তাদের বক্তব্য, জলোচ্ছ্বাস হওয়ার জন্য প্রবল ভূমিকম্প হওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু সমকালীন কোনো নথিতে তার উল্লেখ নেই। বুধবারের আম্ফানের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে আরো ভয়ঙ্কর ছিল ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের ঘূর্ণিঝড়। 

একটি সূত্রের দাবি, ১৭৩৭ সালের ১১ অক্টোবর রাতে যে পথে ঘূর্ণিঝড় সাগর থেকে কলকাতার দিকে বয়ে এসেছিল, এ দিন আম্ফানের গতিপথের সঙ্গে তার বহু মিল! ১৯৯৬ সালে আবহাওয়া দপ্তরের ‘মৌসম’ পত্রিকায় আবহাওয়া বিজ্ঞানী এ কে সেনশর্মা ১৭৩৭ সালের ঝড় নিয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। সেখানে ঝড়টির যে গতিপথ আন্দাজ করেছিলেন তাতে দেখা যাচ্ছে, সাগরদ্বীপের তলা থেকে উঠে কলকাতার উপর দিয়ে মধ্যবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে গিয়েছিল ঝড়টি। আম্ফানের গতিপথও অনেকটা একই রকম ছিল।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.