বিদ্রোহী কবির লেখনীতে ফুটে উঠেছিল কালী-বন্দনা, কট্টরপন্থী মুসলিমদের রোষানলে পড়েছিলেন নজরুল


Odd বাংলা ডেস্ক: কবি কাজী নজরুলের লেখা কয়েক হাজার গান ও কবিতার মধ্যে বিশেভাবে স্থান পেয়েছে শ্যামাসঙ্গীত। ১৯৬৬ সালে প্রায় ১০০টি শ্যামাসঙ্গীত সংকলিত একটি গ্রন্থ 'রাঙা জবা' প্রকাশিত হয়েছিল। কবির শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল এই বই। শক্তির আরাধনায় তাঁর ভক্তমনের অকৃত্তিম ভালবাসা এবং আকুলতাই 'রাঙা জবা'র ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। গ্রন্থটির মূল্য ছিল তিন টাকা। কবি তাঁর অধিকাংশ গানে নিজেই সুরারোপ করেছিলেন তাই, সেগুলিকে নজরুলগীতিও বলা হয়ে থাকে। আর এই নজরুলগীতির একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত।

কবির শ্যামাবন্দনা কিন্তু সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিল। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, 'চণ্ডী' বা 'দুর্গা'-রই একটি বিশেষ রূপ হল 'কালী' বা 'শ্যামা'। বৌদ্ধ বজ্রযান তন্ত্রসাধনায় যিনি ছিলেন 'ডাকিনী-যোগিনী' রূপে আবার তিনি চণ্ডী-তে মুণ্ডমালিনী দিগ্বসনা যুদ্ধরতা 'শ্যামা মা'। কিন্তু তাঁর রূপের বর্ণণা কিন্তু নজরুল দিয়েছিলেন একদম অন্যরকম করে।  সত্যি কথা বলতে, কাজী নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, তাঁর আবেগের গভীরতা। অনেকে আবার এও মনে করেন, তাঁর হৃদয়ের গভীরতায় শ্যামা মায়ের জন্য ভক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। আর সেই ভক্তি তাঁর গানের কথার মধ্যে দিয়েই নিজের আকার দারণ করেছিল। তিনি লিখেছেন- 

''ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে''

এছাড়াও শ্যামা মায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন-
''মার হাতে কালি মুখে কালি,
মা আমার কালিমাখা, মুখ দেখে মা পাড়ার লোকে হাসে খালি।
মোর লেখাপড়া হ'ল না মা, আমি 'ম' দেখিতেই দেখি শ্যামা,
আমি 'ক দেখতেই কালী ব'লে নাচি দিয়ে করতালি।''

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতের স্বকীয়তা এবং তার মৌলিক গুণের কারণেই কিন্তু আপামোর বাঙালির কাছে তথা বাংলা সঙ্গীত জগতে তাঁর বিস্তার সুদূরপ্রসারী। কিন্তু যতই হোক কালী তো হিন্দু দেবী। তৎকালীন মুখপোড়া সমাজে কিন্তু তাঁর শ্যামা-প্রেমকে বাঁকা চোখেই দেখা হত। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার তরজা চলত। সেইসময়ে হিন্দুদের একটি অংশ তাঁকে বিজাতি বলে মনে করত। তেমনই মুসলিম সম্প্রদায়ও তাঁকে বিজাতি বলেই ঘোষণা করেছিল! শুধু তাই নয়, কট্টর মুসলিমরা তাঁকে কাফির আখ্যাও দিয়েছিলন। 

আমার কৈফিয়ত কবিতায় কবি লিখেছিলেন- 
'মৌ-লোভী যত মৌলভী আর 'মোল-লারা' ক'ন হাত নেড়ে,
দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!'

বাংলা সাহিত্যের খুব কম সাহাত্যিক আছেন, যাঁদের নিয়ে চরম মাত্রায় সমালোচনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তালিকায় সবার শীর্ষে নাম রয়েছে কাজী নজরুলের। বিশেষত কট্টরপন্থী মুসলিমদের, কবি নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণ ছিল, তাঁর শ্যামাসঙ্গীত। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) কাজী নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতের সম্প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজকের যুগে শ্যামাসঙ্গীতের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার প্রথম নাম আসে কাজী নজরুল ইসলামের। শ্যামাসঙ্গীতের মধ্যে দিয়েও যে একটা নিঃশব্দ বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছেন কবি, সেকথা বলাই বাহুল্য। তাঁর লেখা এবং সুর করা শ্যামাসঙ্গীত পরবর্তীকালে অসংখ্য শিল্পী গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। 

আপনাদের জন্য রইল কবি নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতের ১০টি গানের সংকলন-
Blogger দ্বারা পরিচালিত.