মারোত্তিচাল, ভারতের যে গ্রামে আট থেকে আশি সবাই দাবা খেলার মাস্টার



Odd বাংলা ডেস্ক: উত্তর কেরলের মারোত্তিচাল গ্রামটি ‘চেস ভিলেজ’ নামে পরিচিত। গ্রামের ১০০ শতাংশ মানুষই দাবা খেলায় দক্ষ। একটা সময়ে এই গ্রামের বাসিন্দারা জুয়া আর মদে মতো খারাপ নেশায় আসক্ত ছিল। গ্রামেরই এক যুবক উন্নিকৃষ্ণণ কাছেরই একটি ছোট একটি শহরে থাকতেন। সেখানে তিনি দাবা শেখেন। গ্রামে ফিরে অন্যদেরও তিনি দাবা শেখান। আস্তে আস্তে গ্রামে র লোকজনের মধ্যে দাবা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দাবা। মদ, জুয়া ছেড়ে দাবায় আসক্ত হয়ে পড়েন গ্রামবাসীরা। দাবার জন্য মারোত্তিচাল গ্রামের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এখানকার স্কুল সিলেবাসেও দাবা আছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই দাবা শিখতে আসেন এই গ্রামে।

জুয়া এবং অ্যালকোহল মুক্ত করার প্রয়াসে গ্রামেরই কিছু ব্যক্তি এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগে এলাকায় বেশ কয়েকবার অভিযানও চালানো হয়। তারপরও গ্রামের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছিল না। গ্রামের মানুষদের এ দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিতে সি অন্নিকৃষ্ণান নামের এক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। তার নিরলস প্রচেষ্ঠায় পুরো গ্রামটি আমূল পাল্টে যায়। কীভাবে গ্রামটি বদলে গেল, সে গল্প এবার শোনা যাক। সি অন্নিকৃষ্ণান মারোত্তিচাল গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি ছিলেন দাবা খেলার ভক্ত। এটি ভারতের খুব প্রাচীন এক খেলা। ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে খেলাটির প্রথম প্রচলন হয়। তখন থেকে এটি ভারতবর্ষের সর্বত্রই খেলা হয়ে থাকে। অন্নিকৃষ্ণান দাবাড়ু ববি ফিশারের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে সবচেয়ে কমবয়সী আমেরিকান দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন। দাবা ছিল তার কাছে আবেগের এক স্থান। 





যুবক বয়সে গ্রামের দুরবস্থা দেখে গ্রাম থেকে চলে গিয়ে পাশের এক ছোট শহরে বাস করতে থাকেন। সেখানে থাকতে তিনি দাবা খেলা শেখেন। ধীরে ধীরে দাবার প্রতি তিনি খুবই অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এদিকে গ্রাম থেকে চলে আসার পরও সেই চিরচেনা গ্রামবাসীদের প্রতি টান তার এতটুকুও কমে যায়নি। প্রতিনিয়ত তাদের জন্য ভাবতেন। চিন্তা করতেন, কীভাবে গ্রামবাসীদের জীবনে পরিবর্তন ঘটানো যায়। দাবার প্রতি ভালোবাসা থেকে তার মনে হলো, যদি এলাকার মানুষদের মাঝে এ খেলাটি ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে গ্রামের দুরবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও হতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজ গ্রামে ফিরে যাবেন। গ্রামে ফিরে প্রথমে তিনি একটি চায়ের স্টল খোলেন। স্থানীয়রা যখন চায়ের কাপে চুমুক দিতে তার স্টলটিতে আসতেন, তিনি তাদেরকে তখন চায়ের সাথে দাবা খেলার বিষয়ে নানা রকম ধারণা দিতে থাকেন। গ্রামের লোকেরা প্রথমদিকে দাবা খেলার প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো কয়েকজন যুবকের এ খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে গ্রামের অন্যান্য অধিবাসীর মাঝে খেলার প্রতি আগ্রহ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইতোমধ্যে অন্নিকৃষ্ণান গ্রামের প্রায় সাতশো জনকে দাবা খেলায় প্রশিক্ষিত করেন। গ্রামের যে ব্যক্তিরা জুয়া ও মদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, অন্নিকৃষ্ণান তাদেরকেও দাবা খেলা শেখাতে শুরু করেন। তারাও সময়ের সাথে সাথে দাবা খেলায় অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এভাবে রাতারাতি পাল্টে যায় গ্রামের চিরচেনা অভ্যাস আর আচার-আচরণ। 

 গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে খেলাটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অন্নিকৃষ্ণানের উৎসাহ আর আগ্রহে গ্রামের পুরুষ থেকে শুরু করে যুবক, যুবতী এমনকী বয়স্ক নারীরাও এর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। বর্তমানে অন্নিকৃষ্ণান একটি রেস্তোরাঁ খুলেছেন, যেখানে লোকেরা যেকোনো সময় দাবা খেলতে আসতে পারেন। অ্যালকোহলে আসক্ত গ্রামটি এভাবে দাবায় আসক্ত হয়ে পড়তে থাকে। ক্ষতিকর মদ ও জুয়ার আসক্তি থেকে সবাই সরে আসতে থাকেন। দাবা খেলায় আগ্রহের পর থেকেই এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হওয়ার এই উত্তেজনাপূর্ণ মজার খেলাটি গ্রামবাসীদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠতে শুরু করে। এ খেলা যেন তাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। মজার বিষয় হলো, গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ছ' হাজার। আর তার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি লোক এখন ব্যস্ত দাবা খেলায়! এমনকি গ্রামবাসীরা টেলিভিশন দেখার চেয়েও দাবা খেলা ও একে অপরের সাথে কথা বলা পছন্দ করেন। দাবার জন্য মারোত্তিচাল গ্রামের খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া। গ্রামের স্কুল সিলেবাসেও দাবা বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়েছে।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.