শ্রীরাধাকে কেন বিয়ে করেননি শ্রীকৃষ্ণ, কী বলছে শাস্ত্র



Odd বাংলা ডেস্ক: ভারতীয় পরম্পরায় প্রেমের পরমতম উদাহরণ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার প্রেম। যুগে যুগে কালে কালে উদাহরণ হয়ে থেকেছে এই ভালবাসা। ভারতীয় পরম্পরায় প্রেমের স্বাভাবিক পরিণতি হল বিবাহ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এই চিরায়ত যুগলই কন্তু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন উদিত হয়, কেন শ্রীরাধাকে বিবাহ করেননি পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ? মনে রাখা প্রয়োজন, ‘মহাভারত’-এ কোথাও শ্রীরাধার উল্লেখ নেই। সেখানে কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মীনি, সত্যভামা প্রমুখ। কিন্তু কদাপি উল্লিখিত নন শ্রীরাধা। শশীভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর মহাগ্রন্থ ‘শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ’-এ স্পষ্টতই দেখিয়েছেন, শ্রীরাধা নামের চরিত্রটি একান্তভাবেই পরবর্তী কালের বৈষ্ণব সাহিত্যকারদের অবদান। মহাভারত-এ তিনি অনুপস্থিত। শশীভূষণবাবুর মতে, এই চরিত্র আসলে এমন এক নির্মাণ, যার পিছনে কাজ করছে কয়েক হাজার বছরের দর্শন-ভাবনা।

• বৈষ্ণব দর্শন মতে, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা পূর্ণব্রহ্মস্বরপ। তাঁরা এক অখণ্ড সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধনে তাঁদের যুগলকে ভাবাই সম্ভব নয়।

• পরবর্তীকালে যখন শ্রীকৃষ্ণের কল্পনা পূর্ণাবয়ব পায়, তখন তাতে মিশ্রিত হয় মহাভারত, ভাগবত, গীতা ও বিভিন্ন পুরাণ থেকে আহৃত তথ্য। সব মিলিয়ে কৃষ্ণকে পুরুষোত্তম হিসেবে কল্পনা করা হতে থাকে। এই বিন্দু থেকে গীতায় উক্ত উবাচ— ‘শ্রীকৃষ্ণই যাবতীয় প্রেমভাবনার আধার’-কে বিচার করলে বোঝা যায়, শ্রীরাধার তরফ থেকে আলাদা করে ‘প্রেম’ বলে কিছু হতে পারে না। তাঁর চৈতন্য সম্পূর্ণতই কৃষ্ণময়। সেখানে লৌকিক বিবাহের কোনও প্রয়োজন নেই।

• রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম বিশুদ্ধ প্রেমের উদাহরণ। কিন্তু এই প্রেমের প্রকৃতি ‘পরকীয়া’। এর মানে মোটেই পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যাভিচার নয়। এর আধ্যাত্মিক অর্থ হল— ‘স্ব’ বা নিজের থেকে বেরিয়ে এসে প্রেম ভাবনা। রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম আত্ম থেকে বেরিয়ে এসে পরমচৈতন্যের সন্ধান। সুতরাং, সামাজিক বিবাহ সেখানে অবান্তর।

• রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম দেহাতীত। বিবাহ মানেই সেখানে দেহজ প্রেম ও তা থেকে ক্রমে সংসারের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। এই স্বর্গীয় প্রণয় তাই কখনই বিবাহে রূপ পেতে পারে না।

• মনে রাখতে হবে, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার প্রণয় শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে শেষ হয়েছিল। এরও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে। এই বিচ্ছেদ দাবি করে পুনর্মিলন। পরম ব্রহ্ম থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা যেমন পরমে লীন হতে চায়, ঠিক তেমন বাবেই রাধাবিরহও ধাবিত হয় কৃষ্ণলীন হওয়ার জন্য। বিবাহ এখানে অসম্ভব। বৈষ্ণব কবিদের মতে, এই বিরহ মহাজাগতিক। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে গ্রহ থেকে গ্রহে প্রেমকে ধাবিত হতে দেখেছিলেন, সেভাবেই এই বিরহ আচ্ছন্ন করে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডকে। ফলে বিবাহ নামক পার্থিব প্রতিষ্ঠানে তাকে ধরে রাখবে কী করে?

• গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে অবশ্য শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার পূর্ণ মিলন সম্ভব হয়েছিল। তাঁরা একই অবয়বে মূর্ত হয়েছিলেন এই ধারধামেই। অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ ও বহিরঙ্গে রাধার সেই মূর্ত রূপের নাম শ্রীচৈতন্যদেব।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.