সেই রাতে ১ লাখ হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তানি সেনা



Odd বাংলা ডেস্ক: পাকিস্তানের দরদ এখন উথলে উঠছে কাশ্মীর নিয়ে। কিন্তু সেই পাকিস্তান সরকারের হয়েই একদিন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে ডাক দেওয়া হয়েছিল অপারেশন সার্চ লাইটের। সেদিন কেঁপে উঠেছিল গোটা বাংলা। এমন কি পশ্চিমবঙ্গের মানুষও এর ভয়াবহতা দেখে চমকে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ রাত্রি ১২টার পর থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের সাংকেতিক নাম। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভিতর দিয়ে- বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে সমূলে ধ্বংস করা এবং পূর্ব-বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা। এই অপারেশন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে। এরপর এই অভিযানের অধিনায়ক টিক্কা খান তাঁর ক্ষমতা আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির কাছে হস্তান্তর করেন।
কয়েকজন বাঙালি নাগরিককে হত্যা করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে টিক্কা খানের সেনা, Image Source: Google


নারীদের ওপর হওয়া অত্যাচার: 

সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে রাজাকাররা চরম অত্যাচার চালায় বাংলাদেশের বহু সাধারণ মানুষের ওপর। অন্তত ৪ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। যার মধ্যে ১ লাখ হিন্দু নারী ছিলেন। 

কিছু বিদেশি সাংবাদিক তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিলেন যে ঢাকার রাস্তায় ধর্ষিতা নারীরা মৃত প্রায় অবস্থায় যেখানে সেখানে পড়েছিল। যৌন লালসা মেটানোর পর ভয়ঙ্কর মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছিল মেয়েরা। দুই পায়ে দড়ি বেঁধে দুটি ট্যাঙ্কেরার সাহায্যে টান দিত তারা। এর ফলে শরীরটা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে যেত। তাতে পাকিস্তানি সেনা হৈহৈ করে উঠত। বাংলাদেশের বুকের সেই রাতে আজও সেই সাংবাদিকরা মনে করলেই কেঁপে ওঠেন। 




কিন্তু কে এই টিক্কা খান?

মূল নাম টিক্কা চাক্কা খান। 
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জুলাই, অবিভক্ত ভারতের রাওয়ালপিণ্ডির নিকটবর্তী জোছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টব্দের ২২শে ডিসেম্বর ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতের দেরাদুনে অবস্থিত সামরিক একাডেমি থেকে কমিশন লাভ করেন।

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে প্রচুর বাঙালিকে হত্যা করে পাকিস্তানে ফিরলেন টিক্কা খান, Image Source: Google


 তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ও ভারতের বিভিন্ন ফ্রন্টে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে দুই বছরেরও অধিক সময় টিক্কা খান যুদ্ধবন্দী থাকার পর পলায়নে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি দেরাদুনে সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের সময় তিনি মেজর হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করে।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত যুদ্ধের সময়, তাঁকে শিয়ালকোটে নিযুক্ত করা হয়।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। এই সময় তিনি লাহোর সেনানিবাসে IV Corps -এর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করেন। এই বৎসরের ২৪শে মার্চ আয়ুব খান পদত্যাগ করলে, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন ইয়াহিয়া খান। এই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সামারিক আইন প্রশাসক হন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে নিষ্ঠুরতার সাথে বালুচিস্তানে বিদ্রোহ দমন করেন। এই কারণে তিনি 'বালুচিস্তানের কসাই' হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেন।

একজন বাঙালিকে হত্যা করার পর তার মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের সেনা, Image Source: Google

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে অপারেশন সার্চ লাইট নামক কুখ্যাত সংঘটিত করার জন্য, পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন লে.জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অপসারিত করে, টিক্কা খানকে গভর্নর করা হয়। একই সাথে তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এবং সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ এই বিপুল ক্ষমতা নিয়ে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ও  মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা। তাঁর ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণের কারণে অনেকে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাই অপছন্দ করতেন। সে সময়ের পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি গভর্নর হিসেবে তাঁকে শপথ বাক্য পাঠে অসম্মতি জানান। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে, বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করে। 
মৃতদেহগুলো তখনও সরানো হয়নি, টিক্কা খানের নৃশংস অত্যাচারের নমুনা, Image Source: Google 
এরপর তিনি মনোযোগ দেন, সারাদেশে সৈন্যদের পুনর্বিন্যাসের দিকে। প্রেসিডেন্ট হন ইয়াহিয়া খান-এর নির্দেশে তিনি বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার আদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু কার্যত তা অনেকাংশে সফল হয় নি। এই সময় বিদেশী সাংবাদিকদের অনেকে লাঞ্ছিত করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়া হয়। টিক্কা খানের এসকল কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল অপারেশন সার্চ লাইট-কে সফল করা। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়।
মার্চ মাসে তিনি ঢাকা আসেন। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রি ১২টার পর থেকে তাঁর পরিচালনায় পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে তিনি পরিচালনা করেন। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভিতর দিয়ে- বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে সমূলে ধ্বংস করা। এই অপারশনে অনেক পাকিস্তানি উর্ধ্বতন সেনানায়করা টিক্কা খানের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না।  তাই ১০ই এপ্রিল টিক্কা খানকে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে, জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর ভিতর দিয়ে 'অপারেশন সার্চলাইট' কার্যত বাতিল হয়ে যায়। 
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে  ১ জুন জেনারেল পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স-১৯৭১ জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন।
 
তথ্যসূত্র: দ্য লাস্ট হিরো অব ইন্দো-পাক ওয়ার
Blogger দ্বারা পরিচালিত.