সংক্রমণের হার কম, খুলছে লকডাউন- করোনা প্রতিরোধে নজির গড়েছে মহিলা শাসিত এই ৭টি দেশ
ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, Odd বাংলা: পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলো কার্যত করোনার থাবায় জর্জরিত। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল বিশ্বের যেসব দেশগুলির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিলারা, সেইসব দেশে করোনা কিন্তু অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যেতে পারে জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, তাইওয়ান, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওে এবং বেলজিয়ামের কথা। এইসব দেশগুলির নেতৃত্বে দিচ্ছেন মহিলারা, আর অদ্ভুতভাবে এইসব দেশে করোনা গ্রাফ কিন্তু আর ঊর্ধ্বমুখী নয়। বরং এইসব দেশে করোনার অ্যাক্টিভ-এর সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। জানেন প্রাণধাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যে যে ব্যবস্থা নিয়েছেন মহিলা শাসিত এই সাত দেশ।
১) গোটা বিশ্বে করোনা প্রতিরোধে সাড়া জাগিয়েছে তাইওয়ান (প্রেসিডেন্ট- তসাই ইঙ্গ-ওয়েন)
জানুয়ারিতে প্রকাশিত জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছিল, চিনের মুল ভূখন্ডের বাইরে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হল তাইওয়ান। চিনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এবং পরিবহনের ব্যবস্থা থাকার সুবাদে ঝুঁকি ছিল সবচেয়ে বেশি। করোনা ভাইরাস যখন চিনের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, ঠিক তখনই দ্বীপ বেষ্টিত এই রাষ্ট্র একটু একটু করে করোনা আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। চিন থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট তসাই ইঙ্গ-ওয়েন (Tsai Ing-wen) হলেন প্রথম কোনও দেশ-নেতা যিনি নিজের দেশের করোনা পরিস্থিতির ওপর নজরদারি শুরু করেন।
২৪ মিলিয়ন মানুষের দেশ তাইওয়ানে তিনি কিন্তু কোনও লকডাউন ঘোষণা করেননি, বরং ২০০৩ সালে সার্স-এর থেকে শিক্ষা নিয়ে, ২০১৯-এর ৩১ ডিসেম্বর যখন চিনের অজানা ভাইরাসের জেরে বিপুল পরিমাণে মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসছিল, তখন তিনি উহান থেকে আগত সমস্ত যাত্রীদের স্ত্রিনিং-এর ব্যবস্থা করেন।
পাশাপাশি প্রাথমিক পদশক্ষেপ হিসাবে চিনের বহু অঞ্চলে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা, চিন থেকে আগত জাহাজ বন্দরে ভিড়তে না দেওয়া, হোম কোয়ারেন্টাইনের আদেশ নিষিদ্ধ করলে কঠোর শাস্তি ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিল তাইওয়ান। শুধু তাই নয়, সরকারের তরফে ন্যুডলস, গুডি ব্যাগ, মাস্ক, অনলাইন গেমিং-এর ফ্রি প্যাকেজ দ্বারা মানুষকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করেছিল। তাইওয়ানে ৪৪৩ জন করোনা পজিটিভ রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে এবং মারা গিয়েছেন ৭ জন। (পরিসংখ্যান- ওয়ার্ল্ডোমিটার)
২) সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জার্মানি (চ্যান্সেলর- এঙ্গেলা মার্কেল)
জার্মান চ্যান্সেলার এঙ্গেলা মার্কেল প্রমাণ করেছিলেন যে, দ্বীপরাষ্ট্রও করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ একেবারে শুরুর দিকেই তিনি তাঁর দেশে করোনা প্রতিরোধে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। দেশের নাগরিকদের ঠিক কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সেই বিষয়গুলিও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। যদিও এখনও পর্যন্ত সেদেশে প্রায় ১.৮৫ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। কিন্তু সেখানে মৃত্যুর হার খুবই কম। এক মিলিয়নে ৪৬ জন।
মার্চ মাস থেকেই সামাজিক দূরত্ববিধি অনুসরণ, যত্র তত্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ২জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ করায় পরিস্থিতি হাতের বাইরে যায়নি। এক জার্মান ভাইরলজিস্ট একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন যে, জার্মান চ্যান্সেলারের শান্ত দৃষ্টিভঙ্গি, স্বচ্ছ কমিউনিকেশন স্ট্র্যাটেজি এবং উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য জার্মানির মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। (পরিসংখ্যান- ওয়ার্ল্ডোমিটার)
৩) দেশের অর্থনীতির চেয়েও মানুষের জীবনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে নিউজিল্যান্ড (প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা আর্ডার্ন)
প্রথম থেকেই নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা আর্ডার্ন বলে এসেছেন কেবল দেশের অর্থনীতি নয়, কঠিন সময়ে মূল্য দিতে হবে মানুষের জীবনকেও। সেদেশে করোনায় প্রথম মৃত্যুর খবর আসার অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলার পদ্ধতি শুরু করে দিয়েছিলেন।
গত ১৯ মার্চ যখন তিনি সেদেশে সমস্ত বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেন, তখন সেদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২৮। এরপর ২৩ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হয় সেখানে, তখন আক্রান্তের সংখ্যা ১০২, মারা যাননি কেউই। সেইসময়ে সেদেশে প্রায় ৫১ হাজার করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়।
ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক মাইকেল বেকার, নিউজিল্যান্ডে করোনভাইরাস সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, নিউজিল্যান্ড হ'ল ভাল বিজ্ঞান ও নেতৃত্বের সংমিশ্রণ। প্রধানমন্ত্রী আর্ডার্ন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলেছেন। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সে শিশুদের প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছিলেন তিনি। আজ নিউজিল্যান্ডে কোনও কোভিড-১৯ রোগী নেই। গত ১৭ দিন ধরে সে দেশে নতুন করে কেউ করোনা আক্রান্ত হননি। যার ফলে ধীরে ধীরে শিথিল করে দেওয়া হচ্ছে লকডাউন। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে সেদেশে করোনা আক্রান্ত ১,৫০৫ এবং মৃতের সংখ্যা ২২। (পরিসংখ্যান- ওয়ার্ল্ডোমিটার)
আরও পড়ুন- কালো মৃত্যু: ১৩৪৭ সালে মহামারি নিয়ে গুজবের কারণেই মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের
৪) দেশবাসীর জন্য বিনামূল্যে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করেছে আইসল্যান্ড (প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন জ্যাকোবসডোট্টির)
আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন জ্যাকোবসডোট্টির তাঁর দেশের সমস্ত নাগরিকদের বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার সুবিধা দিয়েছিলেন। এর ফলে যাঁরা অ্যাসিমটোম্যাটিক (যাঁদের শরীরে রোগের লক্ষণ প্রকট নয়), তাঁদের খুব সহজেই সনাক্ত করা গিয়েছিল এবং মানুষ নিজে থেকে আগ্রহী হয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে এগিয়ে এসেছিলন। জানা যায় আইসল্যান্ডের প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ১০০ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছিল, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ।
তবে অন্যান্য দেশের মতো আইসল্যান্ড কিন্তু পুরোপুরি লকডাউনের পথে হাঁটেনি। যদিও একাধিক ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আংশিকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেদেশে প্রায় ৮০০০ মানুষকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। এমনকি এও ঘটেছে যে, রোগ নির্ণয়ের আগেই রোগীকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। সেখানে মোট করোনা কেসের সংখ্যা ১,৮০৭ আর মৃতের সংখ্যা ১০। (পরিসংখ্যান- ওয়ার্ল্ডোমিটার)
৫) সচেতনতা তৈরি করতে সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিয়েছিল ফিনল্যান্ড (প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন)
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্র প্রধান ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন ফিনিশ জনসাধারণের কাছে তত্ত্ব-ভিত্তিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকেই লকডাউন শুরু হয়ে যায় ফিনল্যান্ডে।
কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষের কাছে সঠিক তথ্য, এবং তত্ত্ব সম্বলিত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফিনিশ সরকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সাহায্য নিয়েছিল। সেদেশের এমার্জেন্সি সাপ্লাই এজেন্সি সরকারি বিভিন্ন বার্তাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
ফিনিশ প্রধানমন্ত্রী দফতর থেকে একজন কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ আপো রিহিমাকি জানান, তাঁরা অবগত যে, সরকারি কমিউনিকেশন সকলের কাছে পৌঁছায় না। আগেকার দিনে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া যেমন টেলিভিশনের মাধ্যমে এই কাজ করা হত, কিন্তু বর্তমানে যুব সম্প্রদায় সমস্ত খবরাখবর পেয়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়া মারফত। আর সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ফিনল্যান্ডে করোনা আক্রান্ত ৭,০০১ , এবং মারা গিয়েছেন ৩২৩ জন। (পরিসংখ্যান- ওয়ার্ল্ডোমিটার)
৬) নরওয়েতে হাসপাতালে ভর্তির হার কমেছে (প্রধানমন্ত্রী এর্না সলবার্গ)
নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এর্না সলবার্গ ফিনল্যান্ডে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছিলেন ১২ মার্চ। নরওয়েতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এই মুহূর্তে ৮,৫৪৭ এবং মৃতের সংখ্যা ২৩৮। তবে খুল অল্প সময়ের মধ্যেই নরওয়েতে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে বলে খবর। নরওয়ের ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেল্থ সূত্রে খবর, গত ২৬ মার্ট থেকে নরওয়েতে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার অনেকটাই কমে গিয়েছে।
নরওয়ের সলবার্গ প্রশাসনের তরফে নরওয়ের বৃহত্তর মোবাইল অপারেটর সংস্থা টেলেনর-এর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি ট্র্যাক করতে সক্ষম হয়েছিল। পাশাপাশি এর্না সলবার্গ স্কুল-কলেজ-রেস্তোরাঁ এবং সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানীগুলি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বাবা-মায়েরা যাতে বাড়িতে থেকে এই সময়ে সন্তানের দিকে বিশেষভাবে যত্ন নিতে পারেন তার জন্য বেতন-সহ ছুটি অনুমোদন করেছিল নরওয়ে সরকার।
এরপর স্থানীয় ক্ষেত্রে সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে একাধিক ক্ষেত্রে জরুরী ব্যবস্থার ওপর শিথিলতা জারি করেছিল। নরওয়েতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৮,৫৪৭ এবং মৃত্যু হয়েছে ২৩৮ জনের। (পরিসংখ্যান- ওয়ার্ল্ডোমিটার)
৭) মানুষ থেকে মানুষ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রুখে দিতে পেরেছে ডেনমার্ক (প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডেরিক্সেন)
ডাচ প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডেরিক্সেন হলেন দ্বিতীয় ইওরোপীয় রাষ্ট্রনেতা যিনি সারা দেশে শাটডাউন ঘোষণা করেছিলেন (১১ মার্চ)। এরপর ১৫ মার্চ তিনি অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেন যেখানে ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর মাইনে এবং প্রতি ঘণ্টায় অর্থ উপার্জন করেন এমন ৯০ শতাংশ মানুষ এই প্যাকেজের আওতায় এসেছিলেন।
ডেনমার্কে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১১, ৯৪৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫৮৯ জনের। কিন্তু মারাত্মক ছোঁয়াচে এই করোনাভাইরাস মানুষের থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার হার অনেকটাই কমেছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার ধীরে ধীরে কমার জন্য একাধিকক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ডাচ সরকার। জনসংখ্যার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ এবং তড়িঘড়ি প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য করোনা সংক্রমণ তিন গুণ বৃদ্ধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছে।
Post a Comment