গোটা কলকাতা জুড়ে এক রকম বিরিয়ানিই বিক্রি হয়, সেটা আওয়াধি বিরিয়ানি, রেস্তোরাঁগুলি বেকার মানুষকে বোকা বানায়



সম্পাদক: লকডাউনের আগে কলকাতার একটি রোস্তোরাঁতে গিয়েছিলাম। বেশ বড় ব্র্যান্ডের রেস্তোরাঁ। দেখলাম মেনু কার্ডে লেখা ৫-৬ রকমের বিরিয়ানি। দাম নেহাত কম নয়। সেখানে উল্লেখ আছে বিভিন্ন ধরনের কুইজিন থেকে আসা বিরিয়ানি। চোখে পড়ল একটা কলকাতা বিরিয়ানি। দাম লেখা ২৬৫ টাকা। আবার তার নিচে লেখা আওয়াধি বিরিয়ানি। দাম ৩১০ টাকা। বহু বছর আগে পড়েছিলাম কলকাতায় বিরিয়ানি নিয়ে এসেছিলেন অবধের সম্রাট ওয়াজিদ আলি শাহ। 

এখন কলকাতায় যদি অবধ থেকে বিরিয়ানি এসে থাকে, তাহলে এখানকার সমস্ত বিরিয়ানিই অবধি বা আওয়াধি। শুধু একটাই পার্থক্য আর সেটা হল আলুর। কিন্তু টেস্ট সেই অবধি বিরিয়ানির। রান্নার নিয়মও একই। মনে রাখতে হবে একমাত্র অবধি বিরিয়ানিতেই দুধ ও মাওয়া ক্ষীরের ব্যবহার করা হয়। আর অবধি বিরিয়ানিই কিন্তু সাদা ও হলুদ রঙের চাল মেশানো। মানে দুরকম রঙের ভাত থাকে এতে। কিন্তু অন্যদিকে হায়দরাবাদ বা দক্ষিণ  ভারতে যে বিরিয়ানির চল আছে তার রঙ কেবলই হলুদ হয়। 

আমি সেই রেস্তোরাঁর মালিককে জিজ্ঞাসা করলাম যে আওয়াধি ও কলকাতা বিরিয়ানি আলাদা ভাবে লেখা হয়েছে কেন? তার উত্তর তিনি দিতে পারলেন না। উল্টে রান্নাঘর থেকে খানসামাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি অদ্ভুত একটা উত্তর দিলেন। বিরিয়ানিতে আলু না দেওয়ার জন্য তারা বেশি টাকা নিচ্ছে। মানে ২৬৫ টাকায় আপনি যে জিনিস পাচ্ছেন মানে বিরিয়ানির চাল, মাংস আর আলু। উল্টে ৩১০ টাকাতে আপনি একটা জিনিস কম পাচ্ছেন, সেটা হল আলু। 

দুঃখের বিষয় ভারতীয় রান্নাঘরের যে একটা বিশাল ইতিহাস আছে সেটা এই রেস্তোরাঁর মালিকরা পড়েন না, জানার চেষ্টাও করেন না।  


সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস 

উনিশ শতকের কথা। তখন বাংলা বানানে লখনউ শহরটাও ছিল অন্য রকম: ‘লক্ষ্ণৌর বাদশা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় শহর বড় গুলজার হয়ে উঠলো।’ লিখছেন হুতোম। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ দিয়েই মুখপাত শ্রীপান্থের ওয়াজিদ-দর্শনের। ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাঁর মোহ তখনও কাটেনি। পরিস্থিতির চক্রব্যূহে কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে এল না, পেনশন নিতে রাজি হয়ে কলকাতাতেই জীবনের বাকি তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন ওয়াজিদ আলি। সেটাই হল কাল। লখনউ থেকে সরে গিয়ে মূল স্রোতের ইতিহাস থেকেও হারিয়ে গেলেন তিনি। ওয়াজিদ আলি অযোধ্যা হারালেন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬, লখনউ ছাড়লেন সে বছরেরই ১৩ মার্চ, কলকাতা এলেন ৬ মে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠল মহাবিদ্রোহের আগুন। তখনও কলকাতায় ভাল ভাবে থিতু হননি ওয়াজিদ আলি, নিতে রাজি হননি পেনশনও। কারণ লন্ডনে তখন ‘আউধ মিশন’ সক্রিয়, তাঁর হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন মা বেগম আউলিয়া আর তাঁর সহযোগীরা। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাওয়ায় সে গুড়েও বালি পড়ল। ব্রিটিশ জনমত পুরোপুরি ঘুরে গেল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। এ দিকে কোম্পানির সরকার হঠাৎ মেটিয়াবুরুজের অস্থায়ী বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করল ওয়াজিদ আলিকে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ একটা তোলা হয়েছিল বটে, তবে তার বিশেষ ভিত্তি ছিল বলে কেউই মনে করেন না। ওয়াজিদ নিজে বিদ্রোহ সমর্থন করেননি, লখনউয়ে তাঁর বেগম হজরত মহল ছেলে বিরজিস কদ্রকে নতুন নবাব ঘোষণা করে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেও। আসলে পাছে বিদ্রোহীরা জোর করে ওয়াজিদকে নেতা হিসাবে তুলে ধরে, হয়তো সেই ভয়েই তাড়াতাড়ি ফোর্ট উইলিয়ামে গৃহবন্দি করা হয় তাঁকে। সেখানে থাকতে হল ২৫ মাস, বিদ্রোহ মিটে যাওয়ারও আট মাস পর তিনি ছাড়া পান। মেনে নেন পেনশনও। এই সময় থেকেই মেটিয়াবুরুজের নবাবির সূচনা। আর তাই ইতিহাসের বইয়ে বেগম হজরত মহল কি বিরজিস কদ্র যেটুকু গুরুত্ব পেয়েছেন, রাজ্যচ্যুত নবাব তা-ও পাননি।


ইতিহাস বলছে, ১৮৫৬ সালের ৬ মে কলকাতায় পৌঁছান নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। এর পর কলকাতাতেই জীবনের শেষ ৩০ বছর কাটিয়ে দেন তিনি। মেটিয়াবুরুজে রাতারাতি যে ছোট লখনউ গড়ে তুলেছিলেন ওয়াজিদ আলি, তাঁর মৃত্যুর পর ততটাই দ্রুততায় তাঁর সব স্মৃতি মুছে ফেলেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সময়কার নবাবি দফতরের কোনও নথিপত্র রক্ষা পায়নি বললেই চলে, নবাবের লেখা কিছু বই ছাড়া। নবাব তৈরি করেন প্রাসাদ, বাগবাগিচা, চিড়িয়াখানা। ৷ এরই সঙ্গে অওয়ধ থেকে তিনি কলকাতায় এনেছিলেন ঘুরি ওড়ানো, কবুতরবাজি ৷ এখানেই শেষ নয় ৷ এই ওয়াজিদ আলির জন্যই কলকাতা বিরিয়ানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তাঁর রসনা তৃপ্তির জন্যই এ শহরে ‘দমপোখ্‌ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না শুরু হয়। অনেকে বলেন, বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন নাকি ওয়াজিদ আলি শাহই করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে বিতর্কও রয়েছে। তবে বিতর্কের ধার ধারে না কলকাতার ভোজন রসিক মানুষজন। বিরিয়ানির স্বাদ-গন্ধকে অনেক আগেই এ শহরের মানুষ আপন করে নিয়েছেন। বিরিয়ানির ইতিহাস নিয়ে এখন আর তাঁরা মাথা ঘামাতে চান না।

বিরিয়ানিতে কেন এল আলু ?

অওয়াধি বিরিয়ানি আর কলকাতা বিরিয়ানি’র মধ্যে তফাৎ একটাই ৷ আর তা হল আলু ৷ ওয়াজিদ আলি শাহ যখন কলকাতায় আসেন, তখন তাঁর কাছে তেমন অর্থ ছিল না ৷ তবে নবাবিয়ানাটা তো রক্তে ৷ তিনি ছিলেন, ‘খানে কা অউর খিলানে কা শওখিন’৷ খেতে এবং খাওয়াতে দারুণ পছন্দ করতেন তিনি ৷ কলকাতায় আসার বেশ কিছু বছর পর বিরিয়ানিতে আলুর যোগ করেন নবাব ৷  তবে শোনা যায়, সে সময় আলুর দাম কিন্তু এত কম ছিল না! পর্তুগিজরা এ দেশে নিয়ে আসে আলু ৷ এদিকে মাংসের দাম এত বেশি! বিপুল পরিমাণে মাংস কিনে বিরিয়ানি তৈরি করার ব্যয়ভারটা কিন্তু সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই ৷ সেই কারণে কিছুটা খরচ বাঁচাতে, এরই সঙ্গে বিরিয়ানির পরিমাণ বাড়াতে আলুর ব্যবহার শুরু হয় ৷ অতএব আলু থাকুক বা না থাকুক 'কলকাতার বিরিয়ানি মানেই সেটা আওয়াধি'।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.