এই যমজ বোন কথা বলত কেবল একে অপরের সঙ্গে, মানসিক অসুস্থতা থেকে মৃত্যুর দরজা পর্যন্ত তাঁদের কাহিনী কল্পনার অতীত


Odd বাংলা ডেস্ক: যখন আমরা ছোট ছিলাম, তখন আমাদের ভাই-বোনদেরই আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড বলে মনে হত। তাদেরকে ঘিরেই গড়ে উঠত একরাশ আনন্দের মুহূর্তে। আর ভাই-বোন যদি যমজ হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। কিন্তু যমজ দুই বোন জুন গিবসন এবং জেনিফার গিবসন-এর জীবনে এই ধারণা একপ্রকার গা ছমছমে, অশুভ, মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল বটে। 

'সাইলেন্ট টুইনস' নামে খ্যাত এই যমজ গিবসন কন্যার জন্ম হয় ১৯৬৩ সালে বারবাদোসে। পরে অবশ্য তাঁরা ব্রিটেনে চলে আসেন, সেখানেই শুরু হয় স্কুলের পঠনপাঠন, আর সেখান থেকেই শুরু হয় কঠিন লড়াই, কারণ শুরুর দিন থেকেই তীব্র জাতিবিদ্বেষের শিকার হন দুই বোন। দিনের পর দিন এইভাবে সকলের চোখে ছোট হতে হতে একপ্রকার একাকী এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন দুই বোন। কারওরই কোনও বন্ধু নেই। এমন পরিস্থিতিতে একে অপরের এক অদ্ভূত সন্ধি করেন, তারা ঠিক করেন যে, তারা কেবল একে অপরের সঙ্গে কথা বলবেন, আর কারওর সঙ্গে কখনও কথা বলবেন না। 

এখানেই শেষ নয়, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য এক অন্যরকম ভাষাও তৈরি করেছিল, যা অনেকটা পাখির কিচিরমিচিরের মতো। পরবর্তীকালে তাদের এই অভিনব ভাষার পাঠোদ্ধার করা হয়, তখন বোঝা যায় যে, তাঁরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতেই কথা বলতেন কিন্তু সেই ভাষা এতটাই দ্রুতগতি সম্পন্ন ছিল যে, এবং অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে বলা হত, তা আদতে পাখির কলতানের মতো শোনাত। 
মানে, আপনি শুধু ভাবুন যে, আপনার পৃথিবীতে আপনার নিজের নিরাপত্তা এবং সান্ত্বনা বলতে কেবল একজনই মানুষ, এবার ভাবুন সেই পৃথিবীতে আপনার একমাত্র আশা-ভরসা ওই মানুষটির ওপর থেকে আপনার সমস্ত নির্ভরযোগ্যতা হারিয়ে যাচ্ছে এবং সম্পর্কের স্বাদ বদলে যাচ্ছে। দুজনের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছে ঈর্ষা এবং বিরক্তিভাব! আর এই একই ঘটনা ঘটেছিল ওই যমজ বোনের ক্ষেত্রেও। ছোটবেলার চুক্তিটা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কাছে যেন কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল। কারণ যমজ হলেও বড় দিদি বারংবারই এটা জাহির করতে চাইত 'চুপ করো, আমি তোমার চেয়ে ১০ মিনিটের বড়'। সাধারণত যমজ ভাই-বোনের মধ্যে যেমনটা হয়ে থাকে আর কি। কিন্তু একে একে অপরেই যেহেতু একে অপরের ভরসা সেহেতু এইধরণের মন্তব্য ও মানসিকতা একে অপরের কাছে ক্রমশই অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে থাকল। 

দুজনেই যখন ঠাহর করে উঠেছিলেন যে, তাঁরা একে অপরের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছেন, তখন দুই বোন শুরু করলেন লেখালেখি, তৈরি করলেন সাহিত্য। এর মধ্যে দিয়েই তারা নিজেদের মনের মধ্যেকার জমে থাকা হতাশা-ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। তাঁরা একাধিক গল্প-কবিতা লিখতে শুরু করেন এমনকি তাঁরা একে অপরের ব্যপারেও লিখতে থাকেন এবং সেইসব লেখায় একে অপরের প্রতি ঘৃণা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। জুন গিবসন তাঁর লেখায় লিখেছিলেন, 'We are both holding each other back....There is a murderous gleam in her eye. Dear Lord, I am scared of her. She is not normal. She is having a nervous breakdown. Someone is driving her insane. It is me.'
আরও পড়ুন- পেয়েছিলেন অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল, ভারতের এই আদিবাসী ব্যক্তির কথা কেউ মনে রাখেনি

এরপর তাদের বয়স যখন ১৪ বছর হল, তখন তাঁদের পরিবার এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁদের আলাদা করে দেওয়া হোক, তাহলে হয়তো তারা বাইরের পরিবারের সঙ্গে মিশবে এবং তাদের সমবয়সীদের সঙ্গে কথা-বার্তা বলবে। কিন্তু দিনে দিনে তাঁদের মধ্যে 'স্কিজোফ্রেনিয়া'র লক্ষণ প্রকট হতে থাকল এবং তাঁরা সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তাঁদের আবার একসঙ্গে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এরপর থেকে তাঁরা একটা ঘরে নিজেদের তালাবন্ধ করে রেখে দিত এবং নিজেদের লেখা চালিয়ে যেত। 

এরপর তাঁরা সৃষ্টি করতে থাকল একাধিক উপন্যাস, যার মধ্যে মার্কিন লেখক স্টিফেন কিং-এর ছোঁয়া ছিল। কিন্তু তাঁদের সৃষ্টি পাঠকের কাছে স্বীকৃতি পায়নি। এরপর তাঁরা কুখ্যাত হয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। বদলে যেতে থাকল ওঁদের জীবন। প্রথমে তারা ছোট-খাটো চুরির কাজ করতে শুরু করল। এরপর তারা লোকের বাড়িতে আগুন লাগানোর মতো অপরাধে লিপ্ত হল। এরপর যখন তাদের গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হল, সেখানে আদালতের নির্দেশে তাদের পরীক্ষা করে দেখা গেল তাঁরা 'সাইকোপ্যাথ'। এরপর তাঁদের ভর্তি করা দেওয়া হয় মানসিক হাসপাতালে। হাসপাতালের নার্স এবং ডাক্তাররাও তাদের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করতে লাগল। তাদেরকে আলাদা আলাদা জায়গায় রাখা হলেও তারা কোনও না কোনওভাবে দেখা করত। এছাড়াও তারা অনেক অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানা করত, এই যেমন দুই বোন পালা করে একদিন ছাড়া ছাড়া উপবাস রাখত এমনকি, দুই বোন আলাদা ঘরে থেকেও একই সময়ে একই কাজ করত, যা কার্যতই সকলকে হতবাক করে তুলত। 

ক্রমে পরিস্থিতি এমন হল যখন তাঁদের মনে হতে থাকল তাঁদের ছায়াই যেন তাঁদের শত্রু। এমনকি তাঁরা চাইত তাঁদের ছায়া যেন তাঁদের শরীর ছেড়ে চলে যায়। ছায়া ছাড়া কি তাঁরা বাঁচতেই পারবে না? -এমন নানাবিধ কথা তাঁদের মাথায় আসত! ওই মানসিক হাসপাতালে থাকাকালীন এমনও হয়েছিল যে, তাঁরা একে অপরকে হত্যা করারও চেষ্টা করেছিলেন! এরপর তাঁদের মনে হল এই পরিস্থিতি থেকে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত বেরতে পারবেন না যতক্ষণ না তাঁদের মধ্যে কেউ একজন মারা যাচ্ছে। এরপর খানিকটা আকস্মিকভাবেই তাঁদের বন্ধুত্ব হয় মাজোরি ওয়ালাসের সঙ্গে, যিনি পরবর্তীকালে দুই বোনের আত্মজীবনী লিখেছিলেন। একমাত্র তিনিই হয়ে ওঠেন তাঁদের একমাত্র বন্ধু।

এরপর একদিন আচমকাই জেনিফার বলেন, 'আমি মরে যাব, কারণ আমরা এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' প্রথমে বিষয়টাতে মাজোরি খুব একটা গুরুত্ব দেননি, এরপরই জেনিফার তাঁকে বলেন 'আমরা দুজনে চুক্তি করেছি যে, আমরা যেদিনই এই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাব এবং আবার সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে পারব, আমাদের মধ্যে একজনকে মরতেই হবে।'

জেনিফারের মৃত্যু-
তাঁদের দুজনের চুক্তি মোতাবেকই চলেন তাঁরা। সেইমতো ১৯৯৩ সালে তাঁদেরকে আর একটি সুরক্ষা কেন্দ্রে স্থানান্তরিত করা হয়। জুন জানান, জেনিফার তাঁর কাঁধে মাথা রাখেন এরপর ক্যাটাটনিক (Catatonic) হয়ে যান। এরপর চোখ খোলা রেখেই ঘুমের ভান করেন। এরপর আচমকাই তাঁর হৃদপিন্ডের প্রদাহের কারণে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এমনকি তাঁর মৃত্যুতে ডাক্তাররাও হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ জেনিফারের শরীর থেকে কোনও বিষও উদ্ধার করা যায়নি। জেনিফারের মৃত্যুর পর জুন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে শুরু করেন। জেনিফারের মৃত্যুর পর তাঁকে স্মরণ করে জুন একটি কবিতাও লেখেন-

'We once were two
 We two made one
 We no more two 
 Through life be one 
 Rest in peace.'
Blogger দ্বারা পরিচালিত.