'সুপারম্যান' চিকিৎসক নিজাম উদ্দিনের গল্প, মৃত্যু আটকাতে সব করতে পারেন যিনি
Odd বাংলা ডেস্ক: ঘটনা বাংলাদেশের তখন প্রায় মধ্যরাত। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে একটি নিথর দেহ পড়ে আছে। পাশেই তার স্বজনরা। মুষড়ে পড়ছেন প্রিয়জন হারানোর বেদনায়। চিকিৎসক ও আছেন সেখানে। হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। যেন বড় অসহায় ক্লান্ত,পরিশান্ত। সক্ষমতার সবটুকু দিয়েছেন। তবুও নিয়তির কাছে পর্যদুস্ত। সম্প্রতি এমনই একটি দৃশ্যপটের ছবি ভাইরাল হয়েছে। মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। ছুয়ে গেছে ভিতরের মমতা, সহানুভুতি, ভালোবাসার কোমল জায়গা। স্থান হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যে চিকিৎসক বীরের মত লড়েছেন তিনি হলেন নিজাম উদ্দিন মিজান। টকবগে তরুন। ৩৯ম বিসিএস এ পাশ করেছেন। এটিই তার প্রথম কর্মস্থল। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর তিনি হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমানতপুর গ্রামে। ২০১৪ সালে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করোনা ফোকাল পারসনের দায়িত্ব তার কাধে। করোনার শুরু থেকেই তিনি তৎপর। করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ, করোনা আক্রান্তদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লকডাউন, চিকিৎসা সেবা প্রদান। এ সব কিছুতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। চিকিৎসক নিজাম উদ্দিনের সাহসিকতার গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
ছবির নেপথ্যের গল্প
রোজকার মত সেদিনই তিনি কাজ করছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ দেয়া,লক ডাউন করা এসব আর কি। এক বাড়িতে গিয়ে একজন শ্বাসকষ্টের রোগীর দেখা পেলেন। অক্সিজেনের মাত্রা তার মাত্র ৩৫%। হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনালেন। রোগীর চিকিৎসা যখন তিনি শেষ করলেন।ত খন রাত এগারটা। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত তিনি। হাত, পা চলছিলো না। এরই মধ্যে খবর পেলেন, স্বাস্থ্য কম প্লেক্সের নীচে একজন রোগী এসেছে। ছুটে গেলেন নিজাম উদ্দিন। রোগীকে সিপিআর দেয়া শুরু করলেন। নিজাম উদ্দিন এ বিষয়ে বললেন, আমি গিয়েই রোগীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে সিপিআর দেয়া শুরু করলাম। এই সিপিআর দেয়া যে কত কষ্টের এইটা একমাত্র যে দিয়েছে সে জানে। আর কেউ জানবে না। একটা সময় রোগীর পালস পেলাম। তখনো সিপিআর দেয়া থামাইনি, চালাচ্ছি। এই কাজে আমাকে শুধুমাত্র সাহায্য করতেসে রোগীর ছেলেটা আর কেউ না। অনেকক্ষন সিপিআর দেয়ার পর আমি আর শক্তি পাচ্ছিলাম না সিপিআর দেয়ার। পিপিই পরেছিলাম সেই বিকেল থেকে। তারপর এন৯৫ মাস্ক পরে স্বাস ও নিতে পারছিলাম না ভালোভাবে। পরে হাঁপিয়ে গেলাম। ছেলেটাও আর পারছিলনা কিন্তু সে চেষ্টা করেই যাচ্ছিল আমার সাথে। পরে খেয়াল করলাম যে রোগীর পালস আর নাই, চোখ স্থির হয়ে গেল, রোগী তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে পড়লাম রোগীর পাশে। চোখের সামনে লোকটা মরে গেল। এইতো একটু আগেই তো হেঁটেই নাকি আসছিল হাসপাতালে।
ভয়কে জয়
দ্বীপ অঞ্চল হাতিয়া। জনসংখ্যা প্রায় পাচ লাখ। কর্মস্থল হিসাবে হাতিয়া। বেশিরভাগ মানুষের কাছেই পছন্দ নয়। ভয়,শংকা কিছুটা থাকেই। শহরাঞ্চল ছেড়ে কেই বা যেতে চায়। কিন্ত চিকিৎসক নিজাম ব্যতিক্রম। হাতিয়ায় আসতে একটু ও দ্বিধায় ভোগেননি তিনি। মানুষের সেবা দিতেই তার শান্তি। অল্প সময়ে হাতিয়াবাসীর মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। হাতিয়ার বাসিন্দা রমিজ উদ্দীনের মুখে শোনা গেলো, নিজাম উদ্দিন শুধু চিকিৎসক নয়। ওনি আমাদের সুপারম্যান। নিজামের সাহসিকতার খবর জানেন নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার। ‘ডা. নিজামের সাহসী ভূমিকার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই অবহিত হয়েছি। হাতিয়ার মতো এমন একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে এত আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করে যাওয়াটা প্রশংসনীয় কাজ।’ বললেন তিনি। রোগীদের সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করে সেবা দেন। তিনি একজন পরিশ্রমী ডাক্তার। এ মন্তব্য উপজেলার চেয়ারম্যান মো. মাহবুব মোর্শেদ লিটনের। হাতিয়ায় ১৫ জন করোনা পজেটিভ রোগী ধরা পড়েছে। উপজেলা মুক্তিযোদ্বা কমপ্লেক্সে ছয় শয্যার আইসোলেশন সেন্টার রয়েছে।
নিজাম উদ্দিন এমনই
সাজেদ উদ্দিন। স্থানীয় বাসিন্দা। পায়ে সমস্যা। চিকিৎসার জন্য নিজাম উদ্দিনের কাছে যান। তখন বিকাল ৫.১৫ মিনিট। নিজাম উদ্দিন অন্য এক রোগীরকে ফোনে সেবা দিচ্ছিলেন। কথা প্র্রসঙ্গে ফোনে বলছিলেন,এখনো দুপুরের খাবার খাননি। প্র্রচন্ড ক্ষুধা লাগলেও খাবার সময়টুকু তার হয়নি। সাজেদ উদ্দিনের ভাষায়, নিজাম উদ্দিন এমনই। রোগীর সেবা দেয়া তার কাছে সব সময় সবার আগে। এক্ষেত্রে নিজের প্র্রয়োজনও তুচ্ছ তার কাছে। হাতিয়াবাসীর সেবায় নিজেকে উজার করে দিয়েছেন নিজাম। হাতিয়ার মানুষের জন্য তিনি যে পরিশ্রম করছেন সে জন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ । বললেন সাজিদ উদ্দিন।
নিজেই নেমে পড়লেন
করোনা টেস্টেও জন্য তিনি হাতিয়াবাসীকে আহবান জানান। তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিলো না। টেস্ট করাচ্ছিলো না। আবার কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছিলো হাতিয়ায় করোনা রোগী কম। ঝুকি ছিলো প্রচুর। তবুও নিজাম নিজেই বাড়ি বাড়ি গেলেন। নমুনা সংগ্রহ, লকডাউন,পরামর্শ, চিকিৎসা সেবা সবই দিতে থাকলেন। ডা. নিজাম উদ্দিনের জানান, মার্চ মাসের ২৩ তারিখ থেকে উপজেলায় করোনা ফোকাল পার্সনের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করে আসছেন মানুষকে সচেতন করতে। কিন্তু কোনোভাবেই সচেতন করা যাচ্ছিলো না। মানুষ উপসর্গ নিয়ে ঘুরছে- গুরুতর অসুস্থ হয়ে কষ্ট করছে তবুও হাসপাতালে এসে নমুনা দিতে চাইছিলো না। উপায়ান্ত না দেখে বাড়ি বাড়ি গিয়েই নমুনা সংগ্রহ করেছেন। হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন। যতদিন থাকবো সততার সাথে হাতিয়াবাসীর সেবা করে যাবো। এটাই নিজাম উদ্দিন মিজানের মনের কথা।
Post a Comment