ছাত্রীকে নারী চিকিৎসক বললেন 'ধর্ষণ করে দিলে তোমার সব চুলকুনি ঠিক হয়ে যাবে!'



Odd বাংলা ডেস্ক: ঘটনা বাংলাদেশের। খবর জানাজানি হতেই হতবাক সবাই। নারীদেরকে শুধু পুরুষরাই যে অসম্মান করেন তা কিন্তু নয়, নারীকে নারীরাও অনেক সময় অসম্মান করেন। ঢাকার এক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর উদ্দেশ্যে এক নারী চিকিৎসকের কথিত মন্তব্য সেরকমই এক দৃষ্টান্ত। সেই ছাত্রীকে স্কয়ার হাসপাতালের নারী চিকিৎসক ডা. কাজী শামসুন নাহার বলেছেন, 'রেপ করে দিলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে!' গত শনিবার ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তার 'ভ্যাজাইনিসমাস' রোগের সমস্যা নিয়ে গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. কাজী শামসুন নাহারের কাছে গিয়ে হয়রানির শিকার হন। মাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন ওই তরুণী। তার অভিযোগ অনুযায়ী, নানা শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক পর্যায়ে ওই চিকিৎসক তাকে বলেন, 'এসব মেয়েদের হাজবেন্ড একটু জংলি টাইপের হওয়া উচিত, যাতে তারা একেবারে রেপ করে ফেলে। একেবারে রেপ করে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।' ওই ছাত্রী তার এক ফেসবুক পোস্টে এ কথা জানিয়ে ওই চিকিৎসককে বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। স্কয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে অভিযোগকে 'অপপ্রচার' বলে অভিহিত করা হয়েছে। তারা বলেছেন, চাইলে ওই ছাত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।

ছাত্রীর বাবার বক্তব্য

ওই ছাত্রীর বাবা জালাল উদ্দিন কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, শব্দ বা ভাষা ব্যবহারে চিকিৎসক ভুল করেছেন। তার হয়রানির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমার মেয়ে ওই ধরনের ভাষা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে।' তবে চিকিৎসকদের ভাষার ব্যবহার এবং আচরণে আরো সংযমী এবং সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

নারীর অসম্মান হরহামেশাই ঘটে

কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে হরহামেশা ঘটলেও তার কোনো প্রতিকার দেখা যায় না। গত সোমবার করোনার ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট দেয়ার দায়ে গ্রেপ্তার হন জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী। সামাজি যোগাযোগ মাধ্যমে তার অপরাধ নিয়ে যত না আলোচনা, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তার 'শরীর' নিয়ে। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দিয়ে যৌন হয়রানিমূলক পোস্টও দেয়া হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা একে বলেছেন, 'ভার্চুয়াল রেপ'। তার মতে, সংবাদমাধ্যমও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।

গত বছর সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী শতকরা ৬৮ ভাগ নারী সাইবার অপরাধের শিকার হন। আর এই অপরাধের ১১টি ক্ষেত্র তারা চিহ্নিত করে। ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের হিসেবে এই অপরাধের যত মামলা হয়, তার প্রায় ৭০ ভাগের শিকার নারী। কিন্তু সেগুলো সংবাদমাধ্যমে আসে না। কারণ, অনেক নারীই সামাজিক কারণে তা প্রকাশ করতে চান না বা গোপন রাখেন। এর ফলে তাদের প্রতিকার পাওয়ার হারও খুবই কম।

স্কয়ার হাসপাতালের ওই নারী চিকিৎসক ছাত্রীটিকে যৌন হয়রানি করেছেন: জবি শিক্ষক

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, নারী যদি যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন, তাহলে তার 'চরিত্র দোষ' প্রমাণের সুযোগ আইনই করে দিয়েছে। ফলে নারীর 'চরিত্র' আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে শুধু নারীর চরিত্রই নষ্ট হয়, পুরুষের হয় না। কাঠামোটাই পুরুষতান্ত্রিক। তার মতে, 'অনেক চিকিৎসাযন্ত্র ও পদ্ধতি আছে, যার চরিত্রই পুরুষ তান্ত্রিক। স্কয়ার হাসপাতালের ওই নারী চিকিৎসক ছাত্রীটিকে যৌন হয়রানি করছেন। কিন্তু সেটা করেছেন তিনি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে।'

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রেখে নারীর প্রতি সহিংসতা বা যৌন হয়রানি বন্ধ করা যাবে না। এখন নানাভাবে নারীদের হয়রানি করা হচেছ। অনলাইনে তাদের ছবি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগে যত অভিযোগ আসে তার ৯০ ভাগই নারীদের হয়রানির অভিযোগ। আর এরমধ্যে আবার ৯০ ভাগ অপরাধের শিকার কিশোরীরা। নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, 'এই সমাজ এখনো নারীদের সম্মান করতে শেখেনি। নারীদের তারা ভোগের বস্তুই মনে করে। ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সবাই নারীকে নিয়ে ব্যবসা করতে চায়।'

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা মনে করেন, স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা একটি অপরাধ। এটাকে চিকিৎসা ব্যবস্থার সাধারণ প্রক্রিয়া বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, 'আমরা ডা. সাবরিনার গ্রেপ্তারের ঘটনায়ও দেখছি তার মূল অপরাধ নিয়ে তেমন আলেচনা নেই। আলোচনা চলছে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য এটা হচ্ছে।'
Blogger দ্বারা পরিচালিত.