আন্দামান-নিকোবর হবে চিনের বিরুদ্ধে লড়ইয়ের কেন্দ্রবিন্দু


Odd বাংলা ডেস্ক: পূর্ব ও দক্ষিণ চিন সাগরের সমুদ্র অঞ্চলে দিন দিন নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে চিন। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে অনেক দেশই তাদের এ কৌশল নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটিকে চিনের আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী আচরণ হিসেবেও দাবি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সমুদ্র অঞ্চলে চিনের এই প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ভারত। এমন পরিস্থিতিতে পূর্ব ও দক্ষিণ চিন সাগরের সমুদ্র অঞ্চলে চিনের আগ্রাসন ঠেকাতে ভারত কৌশলগতভাবে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অত্যাধুনিক ও সুসজ্জিত বন্দর ও ফাঁড়ি স্থাপন করতে পারে। 

এরপর ভারত চিনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির বিষয়ে ভাবতে পারে বলে অভিমত জানিয়েছেন পূর্ব এশিয়াবিষয়ক ভারতীয় পণ্ডিত ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার গীতাঞ্জলি সিনহা রায়। এ ফাঁড়ি হতে পারে সংশ্লিষ্ট সমুদ্র অঞ্চলে চিনকে ঠেকানোর অন্যতম কেন্দ্র। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি’তে প্রকাশিত এক লেখায় এ ব্যাপারে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন গীতাঞ্জলি। পূর্ব এশিয়াবিষয়ক ভারতীয় পণ্ডিত ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার গীতাঞ্জলি সিনহা রায় তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন, চিনকে ঠেকাতে আন্দামান-নিকোবরে ভারত কৌশলগত ফাঁড়ি স্থাপন করলে তা ভিয়েতনামের কাম রান বে বন্দর এবং জিবুতিতে স্থাপিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ফ্রান্সের নৌ ফাঁড়ির মধ্যে কেন্দ্রীয় সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। 

এতে করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দেশগুলোকে নৌপথে সংযুক্ত করতে চিনের গৃহীত প্রকল্প ‘স্ট্রিং অব পার্লস’র (মুক্তার মালা) একটি বিরোধী শক্তি হিসেবে ‘চেইন অব মেরিটাইম হাবস’র উত্থান হতে পারে বলে অভিমত তার। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থল ও সমুদ্র অঞ্চলে চিনের বেশ কিছু আগ্রাসী আচরণ তুলে ধরে গীতাঞ্জলি বলেন, চিনকে ঠেকানোর একটি উপায় হতে পারে সুসজ্জিত বেশ কিছু বন্দর ও দ্বীপকে কৌশলগত ফাঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা, যেগুলো সমন্বিতভাবে এতদঞ্চলের সমুদ্রসীমায় নৌ-কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির নেটওয়ার্ক তৈরি করবে। এতে করে সংশ্লিষ্ট সব দেশই লাভবান হবে। তাঁর লেখায় চিনা আগ্রাসানের কয়েকটি দিক তুলে ধরেন গীতাঞ্জলি। তিনি জানান, এ বছরের এপ্রিলে দক্ষিণ চিন সাগরে ভিয়েতনামের একটি মাছ ধরার জাহাজ ডুবিয়ে দেয় চিনের জাহাজ। 

এ ছাড়া ওই সময় বিরোধের জেরে মালয়েশিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) সমুদ্রসীমায় দেশটির একটি তেল অনুসন্ধানী জাহাজের সঙ্গে চিনের একটি জরিপকারী জাহাজের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এদিকে জুলাইয়ে দুবার চিনা কোস্টগার্ডের জাহাজ জাপানের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে। এ ছাড়া সে সময় ওই অঞ্চলে চিনা কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ জাপানের একটি মাছ ধরার নৌকা আটকানোর চেষ্টা করে। পরে জাপানি কোস্টগার্ড তা প্রতিহত করে। গীতাঞ্জলি সিনহা রায় বলেন, সম্প্রতি চিন মালদ্বীপে একটি কৃত্রিম দ্বীপেরও সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে, যা এ অঞ্চলে ভারতের প্রভাব বলয় খাটো করার চেষ্টা। এ ছাড়া দেশটি ভারত মহাসাগরে একাধিক সাবমেরিন (ডুবোজাহাজ) ও গোয়েন্দা জাহাজ মোতায়েন করেছে। এটি ভারত মহাসাগরে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের খেলা হতে পারে। 



এবং এটিকে পূর্বের ‘স্ট্রিং পার্ল কৌশল’র মতোই ভারতের বিরুদ্ধে চিনের কৌশলগত বৃত্ত রচনার পুনরুত্থান হিসেবে দেখা যেতে পারে। ফলে চিনের এই সামুদ্রিক আগ্রাসন বড়সড় এক উদ্বেগের বিষয়। তাঁর দাবি, সার্বিক প্রেক্ষাপটে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সংযোগকারী হিসেবে ভিয়েতনামের কাম রান বে ও আফ্রিকার জিবুতির মধ্যে কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। নিবন্ধে বলা হয়, ভিয়েতনামের কাম রান বে বরাবরই এক সুসজ্জিত বন্দর। ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে এটি দক্ষিণ চিন সাগরের কাছাকাছি এবং এ বন্দর সব সময়ই বিভিন্ন জলযানে জ্বালানি নেওয়া এবং জাহাজ ও রণতরী মেরামতের জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তিনি লেখেন, কাম রান বে এ অঞ্চলের সমুদ্রপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ও নৌ চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ এক বন্দর। 

এ বন্দরকে চিনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে কাজে লাগানো যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এ বন্দর নিতে পারে, তাহলে আরো অত্যাধুনিক করে গড়ে তুলে এটিকে চিনের আগ্রাসন ঠেকানোর প্রথম বিন্দু হিসেবে কাজে লাগানো যায়। দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের যুদ্ধবাজ আচরণের বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম সব সময়ই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। গীতাঞ্জলী জানান, ২০১৯ সালে আন্দামান-নিকোবরে একটি স্টেশন স্থাপন করে ভারতীয় নৌবাহিনী। এটি উন্নতকরণে কাজ চলছে। এ ছাড়া এ দ্বীপপুঞ্জের উন্নয়নে জাপান চেন্নাই থেকে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে কেবল লাইন নেওয়ার কাজও করছে। ফলে অনেকের মতে, বিরোধী পক্ষের নৌ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে এটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক ফাঁড়ি। 

সার্বিক বাস্তবতায় সমন্বিত নজরদারি পরিচালনায় এটি কাম রান বে ও জিবুতির সংযোগকারী হয়ে উঠতে পারে। লেখায় বলা হয়, চিনকে ঠেকাতে ‘চেইন অব মেরিটাইম হাবস’র প্রথম বিন্দু কাম রান বে বন্দর, মধ্যবিন্দু আন্দামান-নিকোবর ও তৃতীয় বিন্দু বা শেষ বিন্দু হিসেবে কাজ করতে পারে আফ্রিকার দেশ জিবুতি। তবে জিবুতিতে এরই মধ্যে চিনের একটি সামরিক সহায়তা ঘাঁটি রয়েছে। ওই ঘাঁটিটি চিনের পরিকল্পনায় কাজ করে। গীতাঞ্জলি লেখেন, অন্যদিকে মজার ব্যাপার হলো, জিবুতির দক্ষিণাঞ্চলে এরই মধ্যে মার্কিন নৌ ঘাঁটি, ফরাসি বিমান ঘাঁটি ও জাপানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঘাঁটিও রয়েছে। এই তিন দেশের ঘাঁটিই এ অঞ্চলের সমুদ্রসীমায় চিনকে ঠেকাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। 

আগামীতে বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই নির্ভর করবে কারা জলপথ নিয়ন্ত্রণ করে তার ওপর। এ লক্ষ্যেই চিন আঞ্চলিক সমুদ্রসীমাগুলোতে নিজেদের প্রভাব সম্প্রসারিত করছে। একে ঠেকাতে বিভিন্ন দেশকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। গীতাঞ্জলির ভাষায়, সার্বিক বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, ভারত ও ভিয়েতনাম এক জোট হয়ে কাজ করলে বিচক্ষণতার পরিচয় মিলবে। তাদের উচিত পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে কৌশলগত সামুদ্রিক ঢাল তৈরি করা। এ ছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত অংশীদারি জোরদারের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের গঠিত চতুর্দেশীয় সুরক্ষা সংলাপ ফোরাম-কোয়াডের (কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। চিনের আগ্রাসন ঠেকানোর এ প্রচেষ্টায় আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলোকেও।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.