সেই রাতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির, ৮ বছর পরেও আদালত নিশ্চুপ



Odd বাংলা ডেস্ক: মঙ্গলবার ৮ বছর পূর্তি হচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজারের রামুর ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ পল্লীতে ভয়াল সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা। এলাকাবাসী এখন ভুলতে বসেছে এ ভয়াল ঘটনা। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ভয়াল এ হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল। সেই রাতে রামুর ঐতিহ্যবাহী ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ পল্লীতে এক যোগে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তের দল। পরের দিন একই ঘটনার জের ধরে উখিয়া এবং টেকনাফেও আরো ৭টি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত এমন সাম্প্রদায়িক হামলার দিবসটি উপলক্ষে আজ উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। দীর্ঘ ৮ বছর আগে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার এমন ঘটনাটির এ যাবৎ কোনো কুল কিনারা হয়নি। এখনো নিষ্পত্তি হয়নি ১৮টি মামলার। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার। তন্মধ্যে অভিযোগপত্রসমূহে আসামির সংখ্যা ৯৮৪ জন। 

 পরে পুলিশ ব্যুারো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কয়েকটি মামলা পুনঃতদন্ত করে আরো ৩৬ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। মোট মামলার সংখ্যা ১৯টি। এর মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা কেবল একটির আপস সূত্রে বিচার কাজ শেষ হওয়ায় মামলাটির চার্জশিটভুক্ত ৩৮ জন আসামির সবাই খালাস পেয়ে যান। বাদ বাকী ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় কোনো আসামি বর্তমানে কারাগারে নেই। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন-‘এসব মামলার মধ্যে একটির বাদীর সাক্ষি নেওয়া হয়েছে। বাদ বাকি সাক্ষিদের সমনের পরও আদালতে আসেন না। তাই এখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।’ 


 পিপি বলেন, বাস্তবে সাক্ষিরা স্বাক্ষ্য দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কেননা সবাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একই স্থানের বাসিন্দা। সকাল সন্ধ্যা তারা সবাই একই পুকুরের পানি ব্যবহার করে। এলাকায় অটুট রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। তাই কেউ চান না মামলা নিয়ে টানা হ্যাঁচড়ার মাধ্যমে নতুন করে সম্প্রীতি নষ্ট করতে। দীর্ঘ ৮ বছরেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় হতাশ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা এখন এক প্রকার ভুলতে বসেছেন সেই ভয়াল হামলার ঘটনার কথাও। আর এ সময়ের মধ্যে রামুর কয়েক শ বছরের পুরানো বৌদ্ধ সীমা বিহারের অধ্যক্ষ একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ ভিক্ষু শতায়ূ সত্যপ্রিয় মহাথেরো পরলোক গমন করেছেন। গেল বছরের ৩ অক্টোবর পরলোকে পাড়ি জমান তিনি। সেই ভয়াল ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের ভয়াল হামলা থেকে একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই ধর্মীয় নেতা। তিনিও দেখে যেতে পারেননি হামলার ঘটনার বিচার। 

 রামু বৌদ্ধ পল্লীর গৃহবধূ এবং সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ নারী মেম্বার সোনিয়া বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন- ‘বিচার কত চাইব? ঘটনার দীর্ঘদিনের কারণে এসব ভুলে গিয়েছি। কেবল বছরপূর্তির দিনটিতেই একটুখানি মনে পড়ে।’ তিনি বলেন, এলাকায় মুসলিম, হিন্দু-বৌদ্ধ সবাই এক সঙ্গেই বসবাস করে আসছি। কারো সঙ্গে কোনো বিভেদ নেই। ২০১২ সালের সেই ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের অনাকাঙ্ক্ষিত যে ঘটনায় বৌদ্ধ বিহার ও পল্লী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সেই ক্ষত কিছুতেই পোষাবারও নয়। তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে একে একে সবগুলো বিহার অত্যন্ত নান্দনিক ভাবে নির্মাণ করে দিয়েছেন। তাই এখন আর ঘটনার কথা তেমন মনে পড়ে না। তবে রামু সীমা বিহার পরিচালনা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তরুন বড়ুয়া এবং সাধারণ সম্পাদক রাজু বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে একই সুরে জানান, ‘আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সম্পদ পুড়িয়েও যখন আমরা বিচার পাইনি তখন আর বিচার দাবি করছি না। এখন যে রকম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রয়েছে সেটাই অব্যাহত থাকুক অনাদিকাল পর্যন্ত।’ অপরদিকে সীমা বিহারের সহকারী অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু কালের কণ্ঠকে বলেন- ‘অন্তত একটি মামলার হলেও প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হোক। 


যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে।’ রামুর স্থানীয় সংবাদকর্মী সোয়েব সাঈদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বাস্তবে ৮ বছর আগের সেই ঘটনাটি স্থানীয় মানুষ এখন ভুলতে বসেছে। তারা এরকম একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা মনে করেও ব্যথিত হতে চান না আর। প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের রামু উপজেলা সদরের চেরাংঘাটা গ্রামের সুদত্ত বড়ুয়ার পুত্র উত্তম কুমার বড়ুয়া (২৮) নামের এক যুবকের ফেসবুকের একটি কথিত ছবি নিয়েই ঘটেছিল দেশের কলঙ্কিত এতবড় ঘটনাটি। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা রাতে রামুর ফকিরা বাজারের ফারুক কম্পিউটার টেলিকমের মালিক ফারুক এবং স্থানীয় শিবিরকর্মী মুক্তাদির বসে উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক থেকে পবিত্র কোরআন অবমাননার একটি ছবি বের করে। সেই ছবির কথা মুহূর্তেই চাউর হয়ে পড়ে চারিদিকে। আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ মিছিল বের হয় এবং পরবর্তীতে রামু বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে একে একে ৩২টি বসতঘর এবং ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার পুড়ে মুহূর্তেই ছারখার হয়ে যায়। একই ঘটনার জের ধরে পরেরদিন উখিয়া-টেকনাফে আরো ৭টি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং কয়েকটি বসতঘর ভাঙচুর করা হয়। এতদিনেও পুলিশ সেই আলোচিত যুবক উত্তম বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে মুক্তাদির গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে পড়ে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.