যে নারীকে দেখেই নামকরণ করা হয়েছিল এই আমের!


Odd বাংলা ডেস্ক: স্বাদের দিক থেকে অনেকের কাছেই 'আম্রপালী' আম খুবই প্রিয়। আকারে ছোট কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে যেন সব আমকে পিছনে ফেলে দিয়েছে 'আম্রপালী'। কিন্তু এই আমটার নামকরণ কোথা থেকে হল জানেন? রাষ্ট্র তাকে বানিয়েছিল নগরবধূ বা পতিতা। প্রায় আড়াইশ বছর আগে ভারতের অনিন্দ্য সুন্দরী এই নারীর নাম আম্রপালী। তিনি ছিলেন সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এবং নর্তকী। তার রূপে পাগল ছিল পুরো পৃথিবী আর এই রূপই তার জন্য কাল হয়ে ওঠে। যার কারণে তিনি ছিলেন ইতিহাসের এমন একজন নারী, যাকে রাষ্ট্রীয় আদেশে পতিতা বানানো হয়েছিল! আম্রপালী বাস করতেন বৈশালী শহরে। বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিক একটি শহর, যেটি বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের অর্ন্তগত। মাহানামন নামে এক ব্যক্তি শিশুকালে আম্রপালীকে আম গাছের নিচে খুঁজে পান। 

তার আসল বাবা-মা কে ইতিহাস ঘেঁটেও তা জানা যায়নি। যেহেতু তাকে আম গাছের নিচে পাওয়া যায় তাই তার নাম রাখা হয় আম্রপালী। সংস্কৃতে আম্র মানে আম এবং পল্লব হল পাতা। অর্থাৎ, আমগাছের নবীন পাতা। কিন্তু শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিতেই আম্রপালীকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। তার রূপে চারপাশের সব মানুষ যেন পাগল হয়ে গেছে! দেশ-বিদেশের রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তার জন্য পাগলপ্রায়। নানা জায়গায় থেকে তাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া আর বিবাদের খবরও আসতে থাকে। সবাই তাকে একনজর দেখতে চান, বিয়ে করতে চান। এ নিয়ে আম্রপালীর মা-বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারা তখন বৈশালীতে সব গণমান্য ব্যক্তিকে এর একটি সমাধান করতে বলেন। কারণ, সবাই আম্রপালীকে বিয়ে করতে চান। তখন বৈশালীর সব ক্ষমতাবান ও ধনবান ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর যে সিদ্ধান্ত নেন তা হল, আম্রপালীকে কেউ বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ তার রূপ। সে একা কারো হতে পারে না। আম্রপালী হবে সবার। সে হবে একজন নগরবধু, মানে পতিতা। এটা ছিল একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত খুবই বিরল! আম্রপালী সে সভায় পাঁচটি শর্ত রাখেন-

(১) নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় তার ঘর হবে।

(২) তার মূল্য হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা।

(৩) একবারে মাত্র একজন তার গৃহে প্রবেশ করতে পারবেন।

(৪ ) শক্র বা কোন অপরাধীর সন্ধানে প্রয়োজনে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার তার গৃহে প্রবেশ করা যাবে।

(৫) তার গৃহে কে এলেন আর কে গেলেন- এ নিয়ে কোন অনুসন্ধান করা যাবে না।

সবাই তার এসব শর্ত মেনে নেন। এভাবে দিনে দিনে আম্রপালী বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। তার রূপের কথাও দেশ-বিদেশে আরো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। শোনা যায়, তার নাকি পাঁচশ জন স্ত্রী ছিল! নর্তকীদের নাচের এক অনুষ্ঠানে তিনি এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন, এ নর্তকী বিশ্বসেরা। তখন তার একজন সভাসদ বলেন- মহারাজ, এই নর্তকী আম্রপালীর নখের যোগ্যও নয়! বিম্বিসারের এই কথাটি নজর এড়ায়নি। তিনি তার সেই সভাসদের থেকে আম্রপালী সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তাকে কাছে পাবার বাসনা করেন। কিন্তু তার সভাসদ বলেন, সেটা সম্ভব নয়। কারণ, তাহলে আমাদের যুদ্ধ করে বৈশালী রাজ্য জয় করতে হবে। আর আম্রপালীর দেখা পাওয়া এতো সহজ নয়। দেশ-বিদেশের বহু রাজাসহ রাজপুত্ররা আম্রপালীর প্রাসাদের সামনে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। 



কিন্তু মন না চাইলে তিনি কাউকে দেখা দেন না। এত কথা শুনে বিম্বিসারের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যে গিয়ে আম্রপালীকে দেখে আসবেন। কি এমন আছে সেই নারীর মাঝে, যার জন্য পুরো পৃথিবী পাগল হয়ে আছে! তারপর বহু চড়াই উতরাই শেষে আম্রপালীর প্রাসাদ আম্রকুঞ্জে গিয়ে তাকে দেখার সুযোগ পান রাজা বিম্বিসার। কিন্তু দেখা করতে গিয়ে রাজা চমকে উঠেন, এ যেন সাক্ষাৎ পরী! এ কোনোভাবেই মানুষ হতে পারে না। এতো রূপ মানুষের কিভাবে হতে পারে! প্রথম দেখাতেই তাকে মগধ রাজ্যের রাজা বলে চিনে ফেলেন আম্রপালী। তিনি জানান, রাজা যে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন তা তিনি জানেন। এ কথা শুনে রাজা আরো বিস্মিত হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে রাজা তাকে রাণী বানানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু আম্রপালী জানান, তার রাজ্যের মানুষ এটা কখনোই মেনে নেবেন না। উল্টো বহু মানুষের জীবন যাবে। রক্তপাত হবে। তাই রাজাকে দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু বিম্বিসার বৈশালী আক্রমণ করে আম্রপালীকে পেতে চান। ওদিকে আম্রপালী তার নিজের রাজ্যের কোনো ক্ষতি চান না। তাই তিনি রাজাকে তার নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠান এবং বৈশালীতে কোন আক্রমণ হলে তিনি তা মেনে নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এদিকে বিম্বিসারের সন্তান অজাতশত্রুও আম্রপালীর প্রেমে মগ্ন ছিলেন। তিনি বিম্বিসারকে আটক করে নিজে সিংহাসন দখল করে বসেন এবং আম্রপালীকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু দখল করতে সক্ষম হননি এবং খুব বাজেভাবে আহত হন। পরবর্তীতে আম্রপালীর সেবায় সুস্থ হয়ে গোপনে তার নিজের রাজ্যে ফেরত যান। সেদিনও আম্রপালী অজাতশত্রুর বিয়ের প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন। এতো নাটকীয়তার পর শেষের দিকে এসে কি হলো? গৌতম বুদ্ধর সময়কাল তখন। গৌতম বুদ্ধ তার কয়েকশ সঙ্গী নিয়ে বৈশালী রাজ্যে এলেন। একদিন বৈশালী রাজ্যের বারান্দা থেকে এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে আম্রপালীর মনে ধরে গেল। তিনি ভাবলেন, দেশ-বিদেশের রাজারা আমার পায়ের কাছে এসে বসে থাকেন আর এতো সামান্য একজন মানুষ। তিনি সেই সন্ন্যাসীকে চার মাস তার কাছে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন। সবাই ভাবলেন, বুদ্ধ কখনই রাজি হবেন না। কারণ, একজন সন্ন্যাসী এমন একজন পতিতার কাছে থাকবেন; এটা হতেই পারে না। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ তাকে রাখতে রাজি হলেন এবং এটাও বললেন, আমি শ্রমণের (তরুণ সে সন্ন্যাসীর নাম ছিল) চোখে কোন কামনা-বাসনা দেখছি না। সে চার মাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে- এটা আমি নিশ্চিত ! চার মাস শেষ হল। গৌতম বুদ্ধ তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে যাবেন। তরুণ শ্রমণের কোন খবর নেই। তবে কি আম্রপালীর রূপের কাছে হেরে গেলেন শ্রমণ ? সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে আসেন। তার পিছনে পিছনে আসেন একজন নারী। সেই নারীই ছিলেন আম্রপালী। আম্রপালী তখন বুদ্ধকে বলেন, তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখেননি তিনি। কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী। তাই আজ সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চান তিনি। পরে সব কিছু দান করে বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন ইতিহাস বিখ্যাত সেই রমণী আম্রপালী আর এই আম্রপালী নামেই ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা 'দশোহরি' ও 'নিলাম'- এই দু'টি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন 'আম্রপালী'।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.