নেচেই নিজের স্ত্রীর মন ভোলায় এই পুরুষ পাখি
Odd বাংলা ডেস্ক: মান্দারিন হাঁস পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাঁস হিসেবে পরিচিত। এই প্রজাতির পুরুষ হাঁস এতোই রংবাহারি যে, এদেরকে রংধনু মাখা হাঁস বলা যায়। স্ত্রী ও পুরুষ মান্দারিন হাঁসের চেহারায় অনেক পার্থক্য থাকে। প্রজননের সময় পুরুষ হাঁসের ডানায় কমলা রং ও নৌকার পালের মতো দুটি খাড়া পালক থাকে। গোল মাথায় থাকে বাদামি চাঁদি। চোখের উপরে চওড়া সাদা ছিটা-দাগ, ঘাড় ও চিবুক কমলা রঙের ঘন পালকে আবৃত। বগল কমলা, বুক সাদা ও ঠোঁট লাল। চোখ ঘন বাদামি এবং কমলা-পীতাভ পা হলুদ। স্ত্রী হাঁসের পিঠ জলপাই- বাদামি, দেহতল সাদা, সাদা ফুটফুটে বগল ও বুকে সাদা ডোরা থাকে। প্রজনন সময় ছাড়া ছেলে হাঁসের চেহারা প্রায় স্ত্রী হাঁসের মতো, তবে মাথা বাদামি, বুক ও বগলে বিচ্ছিন্ন ফোঁটা থাকে।
জঙ্গলের গহীনে ছোট জলাশয়ে এদের বিচরণ ভূমি। এরা মাঝে মাঝে পৃথিবীর নানা জায়গায় বেড়াতে যায়। তার মধ্যে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও বার্লিন অন্যতম। ভারত ও নেপালে কয়েক বছর পরপর পরিযায়ী হয়ে আসার রেকর্ডও রয়েছে এদের। মান্দারিন হাঁস মিঠাপানির আর্দ্রভূমি, প্লাবিত ধানক্ষেত, বনের কাছের জলধারা ও তৃণময় জলাশয়ে বিচরণ করে। সাধারণত অন্য হাঁসের মিশ্র ঝাঁকে থাকতেই পছন্দ। নারী মান্দারিন হাঁস উঁচু গাছের কোঠরে বাসা তৈরি করে।
এরা গাছের কোটরে বা গুহায় ঘাস ও পালক বিছিয়ে বাসা করে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পীতাভ রঙের, স্ত্রী হাঁস নয় থেকে ১২টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। ২৮ থেকে ৩০ দিন পড় ডিম ফুটে শিশু হাঁসদের আগমন ঘটে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সব ডিম ফুটে যায়। ডিম ফোটা শেষ হলে মা হাঁস মাটি থেকে ছানাদের নেমে আসার জন্য ডাক দেয়।
কোটর বা গর্ত থেকে ছানারা শূন্যে ঝাঁপ দেয় আর আশ্চর্যজনকভাবে কোনো রকম গুরুতর আঘাত ছাড়াই নিরাপদে মাটিতে নেমে আসে আর মায়ের পিছু পিছু কাছাকাছি জলাশয়ে যেয়ে নামে। এসময় পুরুষ মান্দারিন ফিরে এসে ছানা আর স্ত্রী হাঁসের সঙ্গে মিলিত হয়। ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর ছানারা উড়তে শেখে আর নতুন ঝাঁকে যেয়ে যোগ দেয়।
তবে গাছের কোঠরে শিশুদের জন্য কোনো খাবার নেই। খাবার রয়েছে নিচের জলাশয়ে, যা প্রায় ৩০ ফুট নিচে। এদের খাবার তালিকায় রয়েছে জলজ পোকামাকড়, চিংড়ি, কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী ও উদ্ভিদ। তবে সময়ভেদে খাবারের ধরন পরিবর্তিত হয়। যেমন শীতের সময় এ হাঁস শস্যবীজ খেতে ভালোবাসে। বসন্তে প্রধানত জলজ আগাছা ও বীজ, শামুক, পোকা, ছোট মাছ খায়। গ্রীষ্মে ছোট মাছ, ব্যাঙ, শামুক ছোট সাপ খেতে পছন্দ করে। এরা মূলত খুব সকালে ও বেলা শেষে খাবার খায়।
দিনের বেশিরভাগ সময় ও চড়া রোদে গাছের ছায়াময় ভূমিতে বসে থাকে কিংবা এলিয়ে পড়া তরুশাখার নিচের জলে ধীরে ধীরে সাঁতরে বেড়ায়। এই হাঁস ভালো সাঁতারু ও দ্রুত উড়তে পারে। তবে পানিতে ডুব দিতে তেমন পটু নয়। মে থেকে আগস্ট মাস প্রজননের সময়। এসময় এদের ডাকাডাকি বেড়ে যায়। পুরুষ হাঁস স্ত্রী হাঁসের মনোরঞ্জনের জন্য এক ধরনের নাচ প্রদর্শন করে। পরিণত হাঁসদের পাখা থাকায় তারা সহজেই উড়ে নামতে সক্ষম। বাচ্চাদের বয়স যখন মাত্র একদিন, মা হাঁসটি বাচ্চাদের নিচে নেমে আসার জন্য উৎসাহ দিতে থাকে।
শিশুরা প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। তবে ক্ষুধার্ত শিশুদের লাফিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফলে তারা মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে একে একে লাফিয়ে পড়তে থাকে। বয়স মাত্র একদিন হলেও, জীবনযুদ্ধের বাস্তবতা এদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। প্রতিটি শিশুই ভয়কে জয় করার মতো যথেষ্ট সাহসী। তবে কুকুর, উট, ঈগল, প্যাঁচা, সাপ এ পাখির শত্রু। সুযোগ পেলেই এসব প্রাণীর শিকারে পারিণত হতে পারে সুন্দর এ হাঁসেরা।
মান্দারিন হাঁস মূলত জাপান ও চীনের আদি বাসিন্দা। প্রাচীন চীনের শিল্প ও সংস্কৃতিতে এদের অবস্থান স্পষ্ট। তবে এদের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ। ফলে বর্তমানে সাইবেরিয়া, ইউরোপ, উত্তর কোরিয়া এমনকি আমেরিকার কিছু অঞ্চলেও এদের দেখা মেলে। দেখতে ভারী হলেও এদের উড়ার ক্ষমতা অসাধারণ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এরা প্রচণ্ড বেগে ছুটতে পারে। অনিন্দ্য সুন্দর এই হাঁসটির সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ৬৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার নেমে এসেছে। এর মূল কারণ, শিকার এবং বিচরণ ভূমি ধ্বংস হওয়া। তবে এদের টিকে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ। অনুকূল পরিবেশ পেলে এরা হয়তো ফিরে আসবে পূর্ণ উদ্যমে।
Post a Comment