প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী ও ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে স্কুলে যান পশ্চিমবঙ্গের এই শিক্ষিকা



Odd বাংলা ডেস্ক: বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান পাড়ি দেয়া সামান্য সময়ের বিষয় মাত্র। সেখানে এক শিক্ষিকা কিনা ৪৪ কি.মি. পথ পেরিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যান। তিনি যেখানে থাকেন, সেখান থেকে তার স্কুলে পথ বেশ দূর্গম হওয়ায় এভাবেই প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হয় তাকে। নাম তার মিশা ঘোষাল। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের এই শিক্ষিকা হাজির হয়েছিলেন তার নতুন চাকরির স্থানে। ভুটানের তাদিং পাহাড়ের কোলে এক গ্রামের স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব নিয়ে। সেখানকার গ্রামের নাম টোটোপাড়া। 

আদিম, অতি ক্ষুদ্র উপজাতি টোটোদের বাসভূমি। এই গ্রামটির উত্তরে ভুটান সীমান্ত, দক্ষিণে একশৃঙ্গ গণ্ডারের জন্য বিখ্যাত জলদাপাড়া অভয়ারণ্য, অন্যদিকে তোর্ষা নদী। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের মূল আকর্ষণ একশৃঙ্গ গণ্ডার যেমন এক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি, তেমনই এই টোটোরাও। পুরো জনজাতির বেশিরভাগ মানুষই দুরারোগ্য থ্যালাসেমিয়া বহন করেন, তাই এদের গড় আয়ু ৩৫ থেকে ৪০ বছর। এদের সংখ্যা কমতে কমতে ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, মাত্র ৩২১ জন টোটো জীবিত আছেন। তাদের সংরক্ষণের জন্য বিশেষ কর্মসূচি নেয়ার পরে এখন সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২০০০ জনে। সেই সময়ে স্কুলের যিনি সম্পাদক ছিলেন, ভাগীরথ টোটো, তিনি নতুন প্রধান শিক্ষিকাকে হাতজোড় করে বলেছিলেন, এখানে এসে কেউই বেশিদিন থাকতে চান না, তাই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও ঠিকমতো হয় না। 

আপনি যেন ছেড়ে চলে যাবেন না। সেই থেকে মানবিক এই প্রধান শিক্ষিকা সেই গ্রামের স্কুলেই রয়ে গেছেন। এরপর কেটে গেছে ১২টি বছর। মিশা ঘোষালের ছেলে, স্বামী থাকেন শিলিগুড়ি শহরে। তিনি বহুদূরের মাদারিহাটে থাকতেন একা। বাড়ি থেকে স্কুলে পৌঁছতে তাকে পার হতে হয় তিনটে নদী, আরো অনেক ছোট বড় ঝোড়া আর ঘন জঙ্গল। বছর খানেক টোটোপাড়ার রাস্তাতেই একটা বাড়িই করে ফেলেছেন। তিনি বলেন, মাদারিহাট থেকে স্কুলে আসতে ২২ কিলোমিটার পথ পার হতে হত। মাঝে নদী, নালা, জঙ্গল কী না আছে। একটা নদী ভীষণ খরস্রোতা।পানি কমার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয়। একবার তো নদী পেরতে গিয়ে প্রায় ভেসে যাচ্ছিলাম। একটি ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে না ধরে রাখলে ভেসেই যেতাম। কখনো আবার ব্যাগ, চটি ভেসে গেছে। কিছুদিন আগে বড় একটা দুর্ঘটনাতেও পড়েছিলাম। গাড়িতে নদীর শুকনো খাত পার হতে গিয়ে গাড়িই উল্টে গেল। নয়টা সেলাই পড়ল। জঙ্গলের রাস্তা পার হতে গিয়ে পড়েছেন হাতির পালের সামনে বা কখনো চোখে পড়েছে চিতাবাঘ। 

তিনি বলেন, এত কিছুর পরেও ওসব আর কষ্ট বলে মনে হয় না। আবার আমি যে চেষ্টা করছি ওদের শিক্ষার মানটা বাড়াতে, সেটা বুঝে ছাত্রছাত্রীরাও আমাকে অসম্ভব ভালবাসে। যে বছর মিশা ঘোষাল ওই স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সে বছর একজন মাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করতে পেরেছিল। আর যে বছর তিনি জাতীয় শিক্ষকের সম্মান পেলেন, সে বছর পাশের হার হয়েছে ৮০ শতাংশ। ২০ থেকে ২১ জনের মধ্যে ১৭ জন মাধ্যমিক পাশ করেছে এবছর। মিশা ঘোষাল বলেন, ওরা তো এমনিতেই পড়াশোনায় কিছুটা পিছিয়ে, তাই আমি চেষ্টা করি ওদের প্রথাগত পড়াশোনা ছাড়াও নানা ধরণের পদ্ধতির মাধ্যমে ওদের বিকাশ ঘটাতে। কেউ হয়তো অঙ্ক বা বিজ্ঞানে দুর্বল, তাদের অন্যভাবে পড়াশোনার দিকে আকৃষ্ট করতে থাকি, না হলে পিছিয়ে পড়তে পড়তে হয়তো পড়াশোনাটাই ছেড়ে দেবে। এখন হয়তো পাশ করছে অনেকে। তবে আমার লক্ষ্য শিক্ষার মান উন্নত করা। এবছর থেকেই উচ্চমাধ্যমিক বিভাগও চালু করা হল। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে টোটোদের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেছেন তিনি। টোটোদের সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত চর্চা করেন আদতে গণিতের এই শিক্ষিকা। তিনি বলেন, ওদের গানগুলো কী সুন্দর। 

টোটো ভাষায় লিপি নেই, আমি ওদের কাছ থেকে শুনে বাংলাতেই লিখে নিই। স্কুলের অনুষ্ঠানেও আমি ওদের গান গাই। আবার টোটোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, সেগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই জিন্স পরে আজকাল। আমি ঠিক করেছি ওদের সাংস্কৃতিক বিষয়াদি নিয়ে স্কুলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সংগ্রহশালা তৈরি করব। জাতীয় শিক্ষকের সম্মান পাওয়ার পরে প্রশাসনও সহায়তা করবে বলেই মনে হচ্ছে। শুধু স্কুলের জন্য নয়, একটা/দুটো সেতুও শুনছি বানিয়ে দেবে সরকার। আবার সেখান থেকেই সরাসরি পৌঁছে গেছেন দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতির সামনে। শনিবার ওই প্রধান শিক্ষিকা, মিশা ঘোষালকে ভারতের রাষ্ট্রপতি সম্মানিত করেছেন জাতীয় শিক্ষক হিসেবে। প্রতিবছর ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি, জনপ্রিয় শিক্ষক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কয়েকজন শিক্ষককে জাতীয় শিক্ষকের সম্মান দেয়া হয়। 

 এবছর পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুইজনসহ যে ৪৭ জন ওই সম্মান পেয়েছেন, তাদেরই একজন মিশা ঘোষাল- প্রত্যন্ত গ্রাম টোটোপাড়ার ধনপতি টোটো মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। করোনা মহামারির জেরে এবছর জাতীয় শিক্ষক সম্মাননা ভার্চুয়াল পরিবেশে দেয়া হয়েছে। ওই সম্মান নিয়ে গর্বের সহিত বাড়ি ফিরেন মিশা ঘোষাল শনিবার রাতে। তিনি এই অনুভূতি গণমাধ্যমে প্রকাশ করে বলেন, সেক্রেটারির অনুরোধেই এই স্কুলটিতে দীর্ঘদিন ১২ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থেকে অসম্ভব কষ্ট করে যাতায়াত করে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছি টোটো ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনাটা ভালো লাগাতে। নানা রকমভাবে শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছি। হয়তো তারই স্বীকৃতি পেলাম আজ। ভার্চুয়ালি হলেও রাষ্ট্রপতি আমাকে সম্মান জানিয়েছেন। কী যে অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.