অন্ধ স্ত্রীর জন্য বানালো ফুলের বাগান আর সেটি এখন পর্যটনকেন্দ্র
Odd বাংলা ডেস্ক: মিয়াজাকির মিষ্টি মেয়ে ইয়াসুকোর প্রেমে পড়েছিলেন সিনতোমির যুবক তোশিইউকি কুরোকি। একটি মেলায় পরিচয়। সেখান থেকে প্রেম। প্রেমের টানে ৮৯ কিলোমিটার পথ, বাসে, নৌকায়, পাড়ি জমাতেন তোশিইউকি। সমুদ্রের ধারে একান্তে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা চলত স্বপ্নের জাল বোনা। একদিন ইয়াসুকো বলেছিলেন, তোমার খুব কষ্ট হয় আমার কাছে আসতে, আমাকে এবার নিয়ে চলো তোমার কাছে।
একসপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন ইয়াসুকোকে। ফাঁকা জমির মধ্যে একটি ডেয়ারি ফার্ম। শেড দেয়া বেড়ার পাশে ছোট্ট বাড়ি। সেটিই হয়ে উঠেছিল তোশিইউকি ও ইয়াসুকোর জীবনবাসর। সালটা ছিল ১৯৫৬।
স্বামী তোশিইউকির সঙ্গে ফার্মের কাজে হাত লাগাতেন ইয়াসুকো। গরুদের খেতে দেয়া, গোসল করানো, ইঞ্জেকশন দেয়া থেকে শুরু করে গোবর পরিষ্কার করা পর্যন্ত নিখুঁতভাবে করতেন। এরই ফাঁকে স্বপ্ন দেখতেন দু’জন। একটু পয়সা হাতে এলে বেড়াতে চলে যেতেন দু’জনেই। আগে দেখবেন পুরো জাপান, তারপর এক এক করে সব দেশ।
এভাবেই সুখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে কাটছিল তোশিইউকি ও ইয়াসুকোর দিন। জীবনে এসেছিল দুটি ফুটফুটে সন্তান। তাদের লালনপালন ও ডেয়ারি ফার্ম নিয়ে কুরোকি দম্পতি কখন যেন কাটিয়ে ফেলেছিলেন কয়েক দশক। বিয়ের ৩০ বছর পর তোশিইউকি ও ইয়াসুকো সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার কাজ থেকে অবসর নিয়ে দেশভ্রমণে বের হবেন।
কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন স্বপ্নই রয়ে যায় তাদের। ডায়াবেটিস কেড়ে নিয়েছিল ৫২ বছরের ইয়াসুকোর দৃষ্টিশক্তি। প্রাণোচ্ছল চোখদুটি এক মুহূর্তেই হয়ে গিয়েছিল ভাষাহীন। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে ভেঙে পড়েছিলেন ইয়াসুকো। নিজেকে বন্দি করে ফেলেছিলেন ঘরের ভেতর। কোনোভাবেই ইয়াসুকোকে ঘরের বাইরে বার করতে পারছিলেন না, তোশিইউকি ও তার সন্তানেরা।
ঘরের ভেতরে একটা টেবিলে গালে হাত দিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকতেন ইয়াসুকো। খাবার খেতে চাইতেন না। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। জীবন থেকে হাসি পুরোপুরি মুছে গিয়েছিল। নিজেকে স্বামী ও সন্তানের বোঝা ভাবতে শুরু করেছিলেন। শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে যাচ্ছিলেন ইয়াসুকো। মনের কোণে আত্মহত্যার সাপ যেন ফণা মেলছিল
স্বামী তোশিইউকি সারাক্ষণ স্ত্রীকে চোখে চোখে রাখতেন। পাশে বসে পুরোনো দিনের কথা বলতেন। গাল গড়িয়ে অশ্রু নামত ইয়াসুকোর। তোশিইউকি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন স্ত্রীর জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে আনার। কিন্তু ইয়াসুকোর এক কথা, আমার আর দেশ দেখা হল না। ঈশ্বর চোখদুটো কেড়ে নিলেন।
বসন্তের এক পড়ন্ত বিকেল। ফার্মের বাগানে হাঁটছিলেন তোশিইউকি। কয়েকজন ভিনদেশি পর্যটককে দেখেছিলেন তার ফার্মের গোলাপি শিবাজাকুরা ফুল। আর এমন দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে ছবি তুলতে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার দৌড়ে গিয়েছিলেন দলের বাকিদের ডেকে আনতে। এই দলটির কাছে খবর পেয়ে পরের দিন আরো কিছু পর্যটক এসেছিলেন তোশিইউকির ডেয়ারি ফার্মে শিবাজাকুরা ফুলের ছবি তুলতে।
এই ঘটনাটির পর তোশিইউকি একটি অসামান্য সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তার প্রিয়তমাকে দেশবিদেশ আর দেখাতে পারবেন না। তার প্রিয়তমা পৃথিবীর রঙ আর রূপ নিজের চোখে আর উপভোগ করতে পারবেন না। তাই তোশিইউকি সারা পৃথিবীকেই নিয়ে আসবেন প্রিয়তমার কাছে। স্ত্রী ইয়াসুকোর চারপাশে ঘুরতে থাকা বিষন্ন বাতাসে মিশিয়ে দেবেন শিবাজাকুরার সুবাস।
তোশিইউকি স্থির করলেন বাগানে আরো শিবাজাকুরা ফুলের গাছ লাগাবেন। সেই ফুল দেখতে দেশবিদেশ থেকে পর্যটকেরা আসবেন। তারা স্ত্রী ইয়াসুকোর সঙ্গে কথা বলবেন। দেশবিদেশের গল্প শুনবে প্রিয়তমা। যেগুলো নিজের চোখে দেখার বড্ড সাধ ছিল তার।
নাওয়াখাওয়া ভুলে বাগান নিয়ে পড়ে থাকলেন তোশিইউকি। হাজার হাজার গাছ একা হাতে পুঁতলেন ইয়াসুকোর মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। বাগিচার পিছনে কেটে গেল দু’বছর। লাটে উঠল ডেয়ারি ফার্ম। কিন্তু সফল হল অক্লান্ত পরিশ্রম।
দু’বছর পরে বাগান ভরে গেল লাখ লাখ গোলাপি শিবাজাকুরা ফুলে। সুবাস পাওয়া যেত অনেক দূর থেকে। ফুল বাগিচায় আসতে লাগল হরেকরকম পাখি ও প্রজাপতি। ডাক শুনে পাখির নাম বলতেন ইয়াসুকো। ঠোঁটের কোনায় ফিরে এসেছিল হাসি। উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠতেন তোশিইউকি।
মার্চ এপ্রিল মাসে, শিবাজাকুরা ফোটার মরশুমে, প্রতিদিন প্রায় ৭০০০ মানুষ আসেন তোশিইউকি-ইয়াসুকোর প্রেমের বাগিচায়। যে শেডের তলায় একসময় থাকত ৬০ টি গরু, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে পর্যটকদের বাগান তৈরির ইতিহাস বলেন তোশিইউকি। ইয়াসুকোকে আলিঙ্গন করার জন্য পর্যটকদের লাইন পড়ে যায়।
রাতে বাগিচা যখন নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। হাতড়ে হাতড়ে বারান্দার চেয়ারে এসে বসেন ইয়াসুকো। বাগিচার সুগন্ধী বাতাস ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়াসুকোর ওপর।
Post a Comment