আজকের যুগে গান্ধী নীতি আপনার জন্য কতটা কাজ করবে? ভেবে দেখুন
Odd বাংলা ডেস্ক: ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের মধ্যরাত্রে তার অবিস্মরণীয় 'ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি' ভাষণে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মহাত্মার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে, উনি ভারতের সনাতন আত্মার প্রতিনিধি যার মন্ত্র মনে রাখবে আগামীদিনের প্রজন্ম। নেহরুর ভাষণের ঠিক পাঁচ মাস পরে- ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি- এক উগ্র হিন্দুবাদীর হাতেই এই মহান আত্মার মৃত্যু ঘটে। যে দেশের প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি সবচেয়ে বেশি শ্রমদান করেছিলেন, সেই দেশের রাজধানীতেই তার দুর্ভাগ্যজনক অন্তিম পরিণতি ঘটে।
মহাত্মা গান্ধী দুটি নীতি দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন- 'অহিংসা' এবং 'সত্য'- এবং এই দুটি নীতিকে তিনি এক পরিপূর্ণ অর্থ দিয়েছিলেন এবং জাতীয়তাবাদের হেতু ব্যবহার করেছিলেন। পরে মহাত্মার উপরে তৈরি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র 'গান্ধী'-র বিভিন্ন পোস্টারেও বলা হয় যে যে তার সাফল্য পৃথিবীতে এক চিরকালীন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আমি কিন্তু এই অবস্থানের সঙ্গে একমত নই।
একথা অনস্বীকার্য যে, মহাত্মা গান্ধী বিশ্বের প্রথম অহিংস স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের এক অনন্য নেতা ছিলেন। একই সঙ্গে, নিজের নানা বিশ্বাস ও ধারণাকে বাস্তব জীবনে সফল করার চেষ্টায় রত এক দার্শনিকও ছিলেন গান্ধীজি। তা ব্যক্তিগত উন্নয়নার্থে হোক বা সামাজিক বদলের উদ্দেশ্যে, মহাত্মার এই নিরন্তর প্রয়াসে কোনোদিন কোনো ক্লান্তি ছিল না। আর সেজন্যই হয়তো তার আত্মজীবনীর নাম 'দ্য স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ'।
পৃথিবীতে এমন কোনো অভিধান নেই যা 'সত্য'-র অর্থকে মহাত্মার মতো গভীরে গিয়ে অনুধাবন করেছে। গান্ধীর কাছে সত্যের ভিত ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস। সেই সত্য যে শুধু নিখুঁত তা-ই নয়, পাশাপাশি ন্যায্য এবং ঠিক। সত্যের কাছে পৌঁছতে হলে অসত্য এবং অন্যায়ের আশ্রয় নিলে (যার মধ্যে পড়ে অপরপক্ষের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অবস্থান নেওয়াও) কোনোদিনই সেই লক্ষ্যে সফল হওয়া যাবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র একবার গান্ধীর উপরে একটি বক্তৃতায় যোগদান করেন; তার উপরে আধডজন বইও কেনেন এবং সত্যাগ্রহকে নীতি এবং প্রণালী- দুই হিসেবেই গ্রহণ করেন। ভারতের বাইরে যদি কেউ অহিংসাকে স্বার্থকভাবে কাজে লাগিয়ে থাকেন, তবে তা এই কৃষ্ণাঙ্গ নেতা।
লুথার ঘোষণা করেন, "ঘৃণা জন্ম দেয় ঘৃণাকে। হিংসা জন্ম দেয় হিংসাকেই। আমাদের ঘৃণার জবাব দিতে হবে আত্মার শক্তি দিয়ে"।
তিনি এও বলেন যে, তাদের যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, তার অনুপ্রেরণা হিসেবেও তারা দেখেন গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধকেই। ২০১১ সালে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভারতের সংসদে তার বক্তব্য রাখতে গিয়েও বলেন যে, যদি এই পৃথিবীতে গান্ধীজির মতো মানুষের আগমন না ঘটত, তাহলে তার মতো মানুষের রাষ্ট্রপতি হওয়ার খোয়াব চিরকাল খোয়াবই থেকে যেত।
সুতরাং, গান্ধীর মতবাদ যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশকেও প্রভাবিত করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গান্ধীবাদের সাফল্যের খুব বেশি নিদর্শন আজকাল দেখা যায় না। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় উত্তর-উপনিবেশ যুগ। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশই আছে, যাদের স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে ছিল হিংসাত্মক সংগ্রাম। বহু ক্ষেত্রে মানুষ পিষ্ট হয়েছে সামরিক শক্তির পায়ের তলায়; ঘরদোর হারিয়ে তাদের দেশ থেকে পলায়ন করতে হয়েছে; অহিংসার নীতি তাদের কোনো সাহায্যেই আসেনি। আসলে অহিংসার নীতি তাদের বিরুদ্ধেই সফল হয় যাদের মনে নৈতিক পরাজয়ের ভীতি রয়েছে; যাদের ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু গান্ধীর জীবদ্দশাতেও তার অহিংসার নীতি হিটলারের জার্মানির নির্মম দমন-পীড়নের হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচাতে সফল হতো না; হয়ও নি।
গান্ধীর অহিংসার মৌলিক চিন্তা হচ্ছে: "তুমি যে ভুল, সেটা প্রমাণিত করতে আমি নিজেকে শাস্তি দিতেও রাজি।" কিন্তু, ঘটনা হচ্ছে, যদি সেই বিরোধী তাদের ভুল বুঝতে বিন্দুমাত্রও আগ্রহী নয় এবং উল্টো চায় তাদের সঙ্গে অসম্মতি দেখানো বিরোধীদের শাস্তি দিতে, তাদের উপরে অহিংসবাদী আন্দোলনের কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। যদি কেউ তাদের ভুল প্রমাণ করার জন্যে নিজে কষ্ট সহ্য করতে রাজি থাকে, তবে তা তাদের কাছে জয়েরই সমান।
Post a Comment