‘নিষিদ্ধপল্লী’র কন্যা আশা’র জন্য ভালোবাসা


Odd বাংলা ডেস্ক: বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন নিষিদ্ধপল্লী দৌলতদিয়া। আর সেখানেই বাস আশার। সে কেকেএস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। চোখে তার হাজারো স্বপ্ন। স্বপ্ন তার বড় হওয়ার, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। নীল ও সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত আশা প্রতিদিন স্কুলে আসে এই আশায়; পড়ালেখা করে একদিন সে বড় হবে, ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে! আশা বাংলাদেশের বৃহত্তম নিষিদ্ধপল্লী দৌলতদিয়ায় বসবাস করে, তার জন্ম নিষিদ্ধপল্লীতে। তার মা সন্ধ্যা একজন যৌনকর্মী। আশার মা সন্ধ্যা যখন পাশের ঘরে ক্লায়েন্টদের বিনোদন দেয়, তখন আশা পড়াশোনায় আরো বেশি মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে। পাঠে ভালো করতে কঠোর পরিশ্রম করে আশা, পাঠের পাশাপাশি স্কুলে আশা সংগীত শিখছে। দৌলতদিয়া নিষিদ্ধপল্লীতে দেড় হাজারের বেশি নারী এবং এক হাজারের বেশি শিশুর আবাসস্থল। এখানে বড় হওয়া শিশুরা এমন জীবনযাপন করে, যা বোঝা শক্ত। তিন বছরের কম বয়সী শিশুরা মদ ও মাদক আনতে সাহায্য করে, জুয়ার বাজি ধরে, এমনকি তাদের মায়েদের ক্লায়েন্ট চলে যাওয়ার পরে তারা তাদের মা’র ঘর পরিস্কার করতে নিযুক্ত হয়। 

বাংলাদেশে নিবন্ধিত ১৪টি নিষিদ্ধপল্লী রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে, প্রায় বিশ হাজারের বেশি শিশু এসব নিষিদ্ধপল্লীতে জন্মগ্রহণ করে এবং নিষিদ্ধপল্লীগুলোতে বাস করে। নিষিদ্ধপল্লীতে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশন অনুযায়ী সমাজের অন্য শিশুদের মতো একই অধিকার রয়েছে এবং বাংলাদেশ তা অনুমোদনও করেছে। তবে এ কথা চরম সত্য যে, জীবনের প্রথম থেকেই এসব শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার পেতে বৈষম্য এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয়। এসব শিশুরা এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠে, যা তাদের জীবনধারা, গ্রুমিং, ভাষা, আচরণ এবং রীতিনীতিকে প্রভাবিত করে, যা সমাজের দৃষ্টিকোণ অনুসারে মূলধারার সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সামাজিক বর্জনের কারণে এসব শিশুদের অনুন্নত মনো-সামাজিক জীবন দক্ষতা থাকে এবং ইতিবাচক ভূমিকার মডেলগুলি দেখে খুব কম। বাংলাদেশের নিষিদ্ধপল্লীতে বাস করা এসব শিশুদের শিক্ষায় রয়েছে সীমিত প্রবেশাধিকার (ইউনিসেফ, ২০০৯)। যৌনকর্মীদের বাচ্চারা এখনও তাদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত। যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের শিক্ষা প্রদানসহ অন্যান্য সকল মৌলিক চাহিদা পূরণ করা বাংলাদেশের জন্য সহজ ব্যাপার নয়; কারণ এ ক্ষেত্রে সমাজ, স্থানীয় সম্প্রদায়ের পাশাপাশি পতিতালয় থেকেও বাধা থাকে। 

১৯৯৩ সালে কেকেএস যৌনকর্মীদের শিশুদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের জন্য একটি প্রাক - প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে একটি অনানুষ্ঠানিক পাইলট প্রকল্পের আওতায় পতিতালয়ের ভিতরে থাকা ২৫ জন কন্যাশিশুকে নিয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু করেছিল। একই সাথে নিষিদ্ধপল্লীর এলাকার বাইরে ১০০ জন শিশুদের নিয়ে চারটি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটিই ছিল বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রদান কার্যক্রমের প্রথম চেষ্টা। সমস্যা হলো যখন যৌনকর্মীদের শিশুরা নিয়মিত স্কুলে ভর্তি হতে লাগলো, তখন শিক্ষক এবং অন্যান্য সাধারণ শিশুদের পক্ষে কঠিন ছিল এসব বিশেষ শিশুদের সহপাঠী হিসাবে একইভাবে গ্রহণ করা। মূলধারার সমাজের শিশু এবং তাদের অভিভাবকরা এতে রাজি ছিল না। ১৯৯৭ সালে সেভ দ্য চিলড্রেন দৌলতদিয়ায় প্রথম এবং একমাত্র স্কুল চালু করে, যেখানে যৌনকর্মীদের শিশুরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের থেকে স্বাস্থ্যসেবা, খাবার, শিক্ষা এবং প্রচুর ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এখানেই আশা তার বন্ধুদের সাথে পড়াশোনা করতে আসে, যাতে তারা একদিন নিষিদ্ধপল্লী ছেড়ে যেতে পারে। এ স্কুলে বাচ্চারা একটি স্কুলের ইউনিফর্ম, একটি ডায়েরি, পাঠ্য বই এবং স্টেশনারি পায়। বিদ্যালয়ের শিশুদের মাসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা নেয়া হয় স্কুলে। নিষিদ্ধপল্লীতে শিশুরা যাতে প্রায়শই স্কুলে অনুপস্থিত না থাকে সে চেষ্টা করা হয়। কারণ পড়াশোনার জন্য পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু যৌনকর্মীদের শিশুদের এ পরিবেশে ঘরে বসে পড়াশোনা করা প্রায় অসম্ভব। ফলে এসব শিশুদের মূলধারার শিশুদের সাথে বেড়ে উঠা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং তারা যাতে পিছিয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে, কেকেএস স্কুল স্কুলের পরে অতিরিক্ত কোচিং এবং নিষিদ্ধপল্লীর বাচ্চাদের তাদের বাড়ির কাজ শেষ করার জন্য একটি নিরাপদ স্থান সরবরাহ করে। খুলনার ডাকোপ উপজেলার পশুর নদীর তীরে বানিশান্তা নিষিদ্ধপল্লীর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য চালু হয়েছে আবাসিক শিক্ষা। পরীক্ষামূলক কর্মসূচিতে ৫০ শিশুকে আবাসিক শিক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। লেখাপড়ার জন্য বই খাতা দেয়া হয় সেখানে এবং স্কুলে আনার জন্য সবসময় খোঁজ-খবরও রাখা হচ্ছে সেখানে। শিক্ষার পাশাপাশি বিনামূল্যে থাকা খাওয়া ও চিকিৎসা সুবিধাও দেয়া হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানে। বানিশান্তা নিষিদ্ধপল্লীতে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরাও আছে। পর্যায়ক্রমে তাদেরও এই কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। শিশুদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসন ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের এই উদ্যোগে খুশি এসব শিশুদের মায়েরা; সমাজের অন্য শিশুদের মতো তাদের সন্তানদেরও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এখন যৌনকর্মী মায়েরা। 

বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের শিশুরা বুনিয়াদি মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত। অনেক এনজিও, যেমন কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থা (কেকেএস), মুক্তি মহিলা সমিতি (এমএমএস), ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, এবং অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এর অংশীদার সংস্থাগুলি যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের বাস্তবায়ন অংশীদার শাপলা মহিলা সংস্থা ফরিদপুরে মানবাধিকার প্রচারের অধীনে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা করে ‘নিঃস্ব মহিলা ও শিশু প্রকল্প’। শিশুদের সংযুক্ত করতে এই কেন্দ্রটি ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের মূলধারায় যৌনকর্মী এবং তাদের শিশুদের সংযুক্ত করতে জীবন দক্ষতা বাড়ানো। এ প্রকল্পের আওতায় কেন্দ্রে বাচ্চাদের দিন ও রাতের আশ্রয় দেয়ার সাথে স্বাস্থ্যকর ডায়েট, মূলধারার শিক্ষাসহ বিভিন্ন সুবিধা সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি বহির্মুখী এবং বিনোদনমূলক ক্রিয়াকলাপেও এসব শিশুদের অংশগ্রহণ করান হয়। বর্তমানে কেন্দ্রে ২৫ জন শিশু থাকতে পারে, তবে নির্মাণাধীন নতুন একটি স্থায়ী বিল্ডিং আরও ৭৫ শিশু রাখতে সক্ষম হবে। যৌনকর্মীদের শিশুদের জন্য শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের সহায়তা করতে পারে, সহায়তা করতে পারে তাদের পরিবারকে। 

তাদের জীবন উন্নত করার প্রয়োজনে, যাতে করে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সন্তানরা তাদের মায়ের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে এবং তাদের নিজেদেরও মূলধারায় সংযুক্ত করতে পারে সে প্রচেষ্টা চালান হচ্ছে। শিক্ষা অর্জনের পরে আয় অর্জন মূলক পেশায় তারা জড়িত হতে পারে। একইভাবে শিক্ষা সমাজে মূলধারার জন্যও সহায়ক। যৌনকর্মীদের সন্তানরা এখনও আমাদের সমাজের অন্যতম অবহেলিত দল। তবুও যৌনকর্মীরা তাদের সন্তানদের ‘ভালো নাগরিক’ হিসাবে দেখতে চান। সন্তানদের একটু ভালো ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় তারা তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠিয়েছেন, তাদের শিশুদের ভবিষ্যতের বিষয়ে উদ্বিগ্ন যৌনকর্মী মায়েরা। সংস্থার উদ্যোগের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করে যাচ্ছে যৌনকর্মী মায়েদের শিশুদের স্কুলে ভর্তি করে ‘মর্যাদাপূর্ণ’ মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়ার চেষ্টায়। 

 সর্বোপরি, সকল শিশুকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত রাখতে এবং সক্ষম করতে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামাজিক উপলব্ধি পরিবর্তন করতে আমাদের সমাজের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে কাজ করতে হবে। যেমন আইনজীবী, পুলিশ, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং ধর্মীয় নেতাদের এসব শিশুদের প্রতি আচরণ, মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আর ইতিবাচক এবং প্রতিরক্ষামূলক আচরণ এবং মনোভাব সৃষ্টির জন্য বেশি বেশি প্রচার প্রয়োজন। এসব শিশুদের জন্য জরুরি সমাজে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের ভালোবাসতে এবং সমাজের মূলধারায় গ্রহণ করতে এগিয়ে আসতে শিখতে হবে আমাদের শিশুদের। আমাদের মেনে নিতে হবে এরা আমাদেরই শিশু, আমাদের সমাজের অংশ, অংশ আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.