গুলিতে ঝাঁঝরা শরীর, তবুও মৃত্যু নিশ্চিত করতে কেটে নেওয়া হয় হাত!

Odd বাংলা ডেস্ক: একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত ও নিন্দিত চরিত্র তিনি। যার কথা বলছি তাকে সবাই চেনেন এক নামেই। চে গেভারা ছিলেন অদম্য একজন ব্যক্তি। তার প্রধান পরিচয় একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। 

তার প্রকৃত নাম ছিল আর্নেস্টো গেভারা দে লা সেরনা। তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে,চে গেভারা বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়। তরুণ বয়সে ডাক্তারি পড়তে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। যেদিকে তাকাচ্ছেন, দেখছেন অর্ধনগ্ন, হাড় জিরজিরে মানুষদের ভিড়। পেটে খাবার নেই, পকেটে টাকা নেই। অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে মৃত্যু। সমাজের একটা বড়ো অংশ ক্রমশ সেঁধিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের ভেতর। আর তাঁদের শরীরের ওপরই বেড়ে উঠছে সাম্রাজ্যবাদ। চলছে পুঁজির খেলা।

এই দৃশ্যই ডাক্তারি ছাত্রটির চেহারা বদলে দিল। ডাক্তারের সাদা পোশাক আর স্টেথোস্কোপ ছেড়ে পরলেন খাকি পোশাক। মাথায় টুপি, হাতে নিলেন বন্দুক। আর্নেস্টো গেভারার খোলস ছিঁড়ে জন্ম নিলেন চে গেভারা। চোখে তাঁর স্বপ্ন, শিরায় শিরায় বইছে আগুন-বিপ্লবের আগুন! ততদিনে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেছে তাঁর। দুজনে মিলে লাতিন আমেরিকায় গেরিলা ঝড় তোলার দিকে এগোলেন।

দিনটি ৮ অক্টোবর, ১৯৬৭ সালের ভোরবেলা। হ্যান্ড মেশিনগান থেকে কান ফাটানো ট্যাট- ট্যাট শব্দ তুলে ছুটে আসছে গুলি। বাতাসে উড়ছে  ক্ষতবিক্ষত ঝোপের ডালপালা,পাতার খন্ডগুলো। চারিদিকে লুটিয়ে বিশ্বস্ত কয়েকজন সঙ্গীর লাশ। গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়েছে তার দুটি পা। হাত থেকে বহুদিনের সঙ্গী রাইফেলটিও ছিটকে ঝোপের মধ্যে হারিয়ে গেছে । ইউরো গিরিখাত ঘিরে ফেলেছে আমেরিকার প্রশিক্ষণ নেয়া বলিভিয়ার সেনা।

বৃত্ত ছোট করতে করতে ক্রমশ এগিয়ে আসছে তারা। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পকেট থেকে হাভানা চুরুট বের করতে যাবেন। ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল জনা কয়েক বলিভিয়ান সেনা। রাইফেল তাক করল তার ওপর। যাকে লাতিন আমেরিকার জঙ্গলে জঙ্গলে ক্ষেপা হায়নার মতো খুঁজছিল আমেরিকা। রাইফেলের নলের সামনে শান্ত হয়ে হাতের পাতাটা রাখলেন। গুলি কোরো না। আমি চে গেভারা। মৃত চে গেভারার চেয়ে জীবিত চে গেভারার দাম অনেক বেশি।

তাই তো আহত অবস্থায় তার হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হলো। আহত চে গেভারার পায়ের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরেই চলেছে। সেই অবস্থাতেই জঙ্গলের পথে তাকে প্রায় চার মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে আসে সেনারা। নিয়ে এলো লা হিগুয়েরা শহরের বাইরে এক স্কুল বাড়িতে। শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ। সেনা বাহিনীর হাতে শোচনীয়ভাবে আহত  চে গেভারা কে দেখেছিলেন বলিভিয় সেনার পাইলট জাই্মে নিনো ডি গুনজমান।

গুনজমান অবাক হয়ে দেখেন, যিনি আর্জেন্টিনার লোক হয়েও  কিউবাকে স্বাধীন করতে রক্ত ঝরিয়েছেন। তার মাথার চুলে জট, সারা গায়ে ধুলা ময়লা। শতচ্ছিন্ন পোশাকে লেগে রয়েছে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। হঠাৎ দেখলে মনে হবে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কোনো পাগল বুঝি। হাত পা বাঁধা। গুনজমান পরে মিডিয়াকে বলেছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় চে গেভারার মাথা সব সময় উঁচু ছিল। সরাসরি প্রশ্নকর্তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে একের পর এক প্রশ্ন শুনে চলেছেন। কিন্তু উত্তর দিচ্ছেন না। 

বাকি দিনটা  আহত চে গেভারার উপর অকথ্য অত্যাচার চলল। তারপরও বলিভিয়ান আর্মি কম্যান্ডাররা জীবিত কমরেডদের সম্পর্কে চে গেভারার মুখ থেকে একটি শব্দ বার করতে পারলেন না।। বুটের লাথি, ছুরির খোঁচা, সিগারেটের ছ্যাঁকা সহ্য করতে করতে ঠাণ্ডা গলায় তামাক চাইছিলেন। কোনোভাবেই তথ্য বের করতে পারছে না তার কাছ থেকে। হাত বাঁধা অবস্থাতেই এসপিনোসাকে জোড়া পায়ে লাথি মেরে দূরের দেয়ালে ফেলে দেন চে গেভারা। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে বলিভিয়ার রিয়ার অ্যাডমিরাল, উগার্তেচের মুখে থুতু দেন চে গেভারা। তার সঙ্গে নোংরা ভাষায় কথা বলার জন্য।

বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে ব্যরেন্টোস, সকাল দশটা নাগাদ , চে গেভারাকে হত্যা করার আদেশ দিলেন। চে গেভারার  মৃত্যু পরোয়ানা এসে গেল সেই ইউনিটের কাছে। যেটির কম্যান্ডার একজন কিউবান। যিনি আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র হয়ে কাজ করছেন বলিভিয়ায়।  এবং বলিভিয়ান কম্যান্ডারের ছদ্মবেশে। নাম ফেলিক্স রড্রিগেজ।

আমেরিকা চাইছিল জীবিত চে গেভারাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পানামা নিয়ে যেতে। কিন্তু বলিভিয়ার নেতৃত্ব চাইছিল চে-এর মৃত্যু। কারণ তারা ভয় পাচ্ছিল জনসমক্ষে চে-এর  বিচার হলে, চে গেভারা  পুরো বলিভিয়ার মানুষের সহানুভূতি পাবেন। ফলে আবার উস্কে উঠবে বলিভিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন। এছাড়াও সমর কৌশলে কিংবদন্তি চে গেভারা , কখন কী ভাবে জাল কেটে বেরিয়ে যাবেন কেউ জানে না।

চে কে বাঁচিয়ে রাখা তাদের জন্য যেমন ঝুঁকি তেমনি মেরে ফেলাও বিপদ। তাই কি করবেন সে নিয়ে চলে দফায় দফায় আলোচনা। অবশেষে বলিভিয়া থেকে বেরোল একটি খবর। সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে নাকি প্রাণ হারিয়েছেন চে গেভারা! মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কিউবায় বসে এমনটা মানতেই পারেননি ফিদেল কাস্ত্রো। তার পরম বন্ধু হয়ত আত্মগোপন করে আছেন।

 সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এমন খবর প্রচার করা হচ্ছে। বাস্তব ছিল অন্যরকম। লা হিগুইরার স্কুলে ফেলিক্সের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত বন্দি চে গেভারা। তিনি কি জানতেন শেষ পরিণতি? হয়তো… না হলে এত ঠান্ডা, শান্ত থাকেন কী করে! এক অদ্ভুত অবস্থায় পড়লেন ফেলিক্স রডরিগেজ। কী করবেন এই মানুষটিকে নিয়ে? শেষ পর্যন্ত ঘরে উপস্থিত সৈন্যটিকে নির্দেশ দিলেন, বন্দুক তৈরি করো। হাতে, পায়ে আর গলায় ঢুকিয়ে দাও বুলেট। থামিয়ে দাও আগুনকে। এক দুই তিন ঘরের ভেতর বেশ কয়েকবার গুলির আওয়াজ শোনা গেল। 

বলিভিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ভালেগ্রান্দেত হাসপাতালের লন্ড্রির ভেতরে লোহার স্ট্রেচারে শোয়ানো রয়েছে একটি দেহ। ফর্সা, খালি গা, পরনে কেবল ময়লা কালো প্যান্ট। কোঁকড়ানো চুল আর দাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিস্পলক চোখ দুটো। দেহে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। চিত্রসাংবাদিকরা বেশ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁদের সামনে, হাসপাতালের স্ট্রেচারে মৃতদেহ হয়ে শুয়ে আছেন চে গেভারা। ঠান্ডা মণির ভেতর তখনও ধিকিধিকি জ্বলছে বিপ্লবের আগুন। 

চে কে তো দুনিয়া থেকে সরানো গেল। কিন্তু তার শরীর? চে গেভারার মতো বিপ্লবীর দেহ যাতে কারোর হাতে না পড়ে, তারই ব্যবস্থা নিল বলিভিয়া সৈন্য। ভালেগ্রান্দের একটি জায়গায় মাটি খুঁড়ে দাফন করা হয় ফর্সা দেহটি। তখনও রক্ত শোঁকায়নি। ফিদেল কাস্ত্রোকেও তো ঠান্ডা করতে হবে! তাকে চে’র মৃত্যুর প্রমাণ পাঠাতে হবে। অগত্যা, কাটো হাত! হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ থেকে দুটি হাতই কেটে নেয়া হল। তারপর ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা হল, যাতে সুযোগ বুঝে তার আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা যায়। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.