চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে কেনা-বেচা করা হত ক্রীতদাস

Odd বাংলা ডেস্ক: টিভি, পত্রিকা কিংবা দেয়ালের পোস্টার। কোথাও বিজ্ঞাপনের কমতি নেই। এমন ওহরহই আপনার চোখে পড়ে নিশ্চয়। তবে যে বিজ্ঞাপনের চিত্রটি দেখছেন সেটি সাধারণ কোনো প্রসাধনী কিংবা অন্য কিছুর বিজ্ঞাপন নয়। ১৭৮৬ সালের ক্রীতদাস বিক্রির বিজ্ঞাপন এটি।

ক্রীতদাস প্রথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এখনও এই ভয়ঙ্কর প্রথাটি বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে এবং বিভিন্ন পরিবারে। বর্তমানে আফ্রিকান আমেরিকানরা অনেকেই ক্রীতদাসদের বংশধর। এমনকি আমেরিকার বর্তমান ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার পূর্ব পুরুষেরা দাস হিসেবে এসেছিলেন আমেরিকায়। অথচ অবাক করা ব্যাপার তাদের বংশধর আজকে আমেরিকার ফার্স্ট লেডি। এছাড়া সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনডোলিৎসা রাইসের প্রমাতামহকে মাত্র ৪ বছর বয়সে দাসী হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল সাড়ে ৪০০ ডলারে।      

এছাড়াও ব্রাজিলের ছন্দময় ফুটবল কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারদাঙ্গা ক্রিকেট কার না ভালো লাগে বলুন? ওয়েস্ট ইন্ডিজের গেইল, ব্রাভোরা কিন্তু সেই ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেডের সময় ধরে আনা দাসদের বংশধর। ব্রাজিলের কালো মানিক পেলের পূর্বপুরুষও কিন্তু ছিলেন দাস। এছাড়া পৃথিবীর দ্রুততম মানব উসাইন বোল্টেরও কিন্তু আদিপুরুষ আফ্রিকান। 

বর্তমান আমেরিকার অতীতের রয়েছে এক কালো অধ্যায়। দাস প্রথার কারণেই ইতিহাসে ঘৃণিত তাদের অতীত। বলা হয়, কলম্বাসই আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চল থেকে কালো মানুষগুলোকে এনে আমেরিকা সমৃদ্ধশালী করতে চেয়েছিল। ক্রীতদাস হিসেবেই এই কালো মানুষগুলোকে বিক্রি করে দেয়া হয়। যেন কোনো পণ্য তারা। 

উপরের বিজ্ঞাপন চিত্রে তেমনটাই দেখতে পাচ্ছেন। একটি কোম্পানি অর্থাৎ একজন দাস ব্যবসায়ী তার কিছু দাস বিক্রি করতে লোভনীয় এবং আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। যা দেখে ধনীরা তাদের পছন্দমতো দাস কিনে নেবেন চড়া দামে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে তাদের কাছে স্বাস্থ্যবান কিছু যুবক দাস রয়েছে। যারা কিনা ধান চাষসহ কঠোর যেকোনো পরিশ্রম করতে পারে। এদের আনা হয়েছে গাম্বিয়ার নদীপাড় থেকে। 

আফ্রিকান বংশভূত এই দাসদের সুলভ মূল্যে বিক্রয় করা হবে। স্বত্বাধিকারী রবার্ট হ্যাজলেউরেস্ট এবং এদের ম্যানটর বা প্রশিক্ষন দিয়েছেন উইলিয়াম লিট্টিয়শন। গত মঙ্গলবার ৭ জুন জাহাজে করে এখানে এসেছে। আপনার পছন্দমতো ক্রীতদাস বেছে নিন। ১৭৮৬ সালের জানুয়ারিতে দেয়া হয়েছিল এই বিজ্ঞাপন।

অবাক হওয়ার কিছু নেই। এভাবেই হাটে নিয়ে ক্রীতদাস কেনা-বেচার প্রথা ছিল। ইতিহাস বলে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। এর হাজারখানেক বছর পর থেকে এই প্রথা মিশর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষে। এর অনেক পরে চীনে এই কু-প্রথাটি জেঁকে বসে। ৮০০ হতে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেশ গ্রিস এবং ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথার ভয়াবহ পদচারণা। এ যেন সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অসভ্যতার আর অমানবিকতার শীর্ষে উঠার প্রক্রিয়া! এভাবে প্রায় বিশ্বজুড়েই একসময় ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়াবহ কু-প্রথাটি। 

যুগে যুগে অনেকেই এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তবে খুব একটা সমাধান করতে পারেননি প্রচলিত সামাজিক ব্যাধির। শুরুতে ক্রীতদাস প্রথার বিস্তার কমই ছিল বলা চলে। তখনও ক্রীতদাসরা উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেনি। পরে মানুষ অমানবিকতার নতুন নতুন কৌশল শিখে নিয়ে ক্রীতদাসদের যারপরনাই অমানবিকভাবে খাটাতে শুরু করে।

জানা যায়, ১৪৯৪ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ৫০০ রেড ইন্ডিয়ানকে দাস করে পাঠিয়েছিলেন স্পেনের রানি ইসাবেলাকে। কলম্বাস ওদের বদলে চেয়েছিলেন শূকর! রানি ইসাবেলা তার প্রস্তাবে রাজি হননি। ক্রীতদাসদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ১৭০০ সালে গিনিতে স্পেন আর পর্তুগাল তো রীতিমতো কোম্পানি খুলে বসেছিল ক্রীতদাসদের নিয়ে। তারা আমেরিকান আর ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বছরে ১০ হাজার টন দাস সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন মানুষও মাপা হতো টন হিসেবে, নিতান্তই সাধারণ মালপত্রের মতোই!

১৬৮০ থেকে শুরু করে মাত্র বিশ  বছরে ইংরেজরা কম করে হলেও দেড় লাখ মানুষকে রূপান্তরিত করেছিল দাসে। এই সময়কালে অন্যান্য ব্যবসায়ীও নিয়োজিত ছিল লাভজনক এই ব্যবসায়। তারাও দাসে পরিণত করেছিল এক লাখা ৬০ হাজার সহজ-সরল মানুষকে। চালাক-চতুর ব্যবসায়ীরা ওইসময় আফ্রিকায় গিয়ে সহজ-সরল মানুষদের প্রতারিত করত। আফ্রিকার নানান গোত্রের দলপতিকে তারা দাওয়াতের মাধ্যমে ব্যাপক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করত। 

ওইসব দলপতিকে প্রদান করত নানা রকম বাহারি উপহার। উপহার পেয়ে সব ভুলে নিজ গোত্রের মানুষদেরই ক্রীতদাস বানাতে সহায়তা করত ওইসব মানুষরূপী দানবরা। প্রাচীন রোমে তো রীতিমতো আইনই করা হয়েছিল যে, দাসদের বিক্রি করা যাবে যার যার ইচ্ছা মতো! পরিসংখ্যান মতে, ১৮৬০ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল ক্রীতদাস। 

এই ভয়ংকর প্রথা আমাদের দেশেও ছড়িয়েছিল। বলতে গেলে পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছিল এই দাস প্রথা। মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথার চালু হওয়ার হাজার খানেক বছর পর থেকে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষে।

ইতিহাসে বিক্রমপুরে দাস বিক্রয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৩২০ সনের ভাদ্রমাসের “সাহিত্য” পত্রিকায় ক্রীতদাস ক্রয়- বিক্রয়ের একটি দলীল প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় ২০০ বৎসর পূর্বেও বিক্রমপুরে অভাবের তাড়নায় পড়ে মানুষ দাসরূপে বিক্রয় হতো এবং ঋণ গ্রহণ করেও অনেকে দাসত্ব স্বীকার করতো। 

ইউরোপ ও আমেরিকায় যেভাবে দাস ব্যবসা প্রচলিত ছিল, আমাদের বিক্রমপুরেও সেইভাবে দাসগণ ক্রয় ও বিক্রীয় হত। বাংলায় মানুষ বিক্রি বা দাস বেচাকেনার অনেক উল্লেখ বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে রয়েছে। মরক্কোর পর্যটক শেখ আবু আবদুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে বতুতা (১৩০৪-১৩৭৭ খ্রি.) প্রায় দুই মাস বাংলায় সফর করার সময় মানুষ কেনা-বেচার ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন, যা তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করেছেন। মসলিন কাপড়, মিহি সুতি বস্ত্র, মসলা প্রভৃতি কেনাবেচার হাটে দাস-দাসী বিক্রি করা হতো বলে বিভিন্ন পর্যটক তাদের বিবরণীতে তুলে ধরেছেন।

মানুষ কিংবা দাস-দাসী বিক্রির চুক্তিপত্রের অধিকাংশই রেজিস্ট্রি করা হতো। বিক্রমপুর, শ্রীহট্ট (সিলেট), চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কালাইয়া বন্দর (বরিশাল), মহেশ্বরদী (নরসিংদী) ও ধামরাই এলাকায় মানুষ বিক্রি ও দাস বেচাকেনার ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শিশু ও বৃদ্ধদের বাজারদর ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। স্বাস্থ্যবান নারী-পুরুষের মূল্য ছিল ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত।

কলকাতা জাদুঘরে রক্ষিত একটি প্রাচীন দলিল থেকে জানা যায়, ১৮০৩ সালে ঢাকার নিকটবর্তী ধামরাই গ্রামের বদন চান্দ নামে এক ব্যক্তি মহাজনের ঋণ শোধ করতে না পেরে তার স্ত্রী সরস্বতী এবং তিন বছরের শিশুপুত্র ডেঙ্গুচন্দকে আত্মবিক্রয় করে দেন কৃষ্ণরাম মৌলিকের কাছে। সংবাদটি ‘সমাচার দর্পণ’-এর ১৮২৫ সালের ১৮ জুন সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। মানসী পত্রিকার ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা থেকে জানা যায়, প্রাচীন বাংলা ভাষায় লিখিত একটি দলিল বিক্রমপুরের মালপদিয়া গ্রাম থেকে পাওয়া যায়।

পূর্বপুরুষদের স্মৃতি হিসেবে দরিদ্র এক কৃষকের কাছে সেটি ছিল। ওই দলিলে অভাবের তাড়নায় আত্মবিক্রি বা নিজেকে বিক্রির বিবরণ রয়েছে। দলিলে গোকুল ঢুলি বকলম দাতা হিসেবে টিপসই দিয়েছেন। দলিলগ্রহীতা ছিলেন কালীকৃষ্ণ দেবশর্মা। দলিল সূত্রে জানা যায়, আর্থিক দৈন্যের কারণে ভরণপোষণের বিনিময়ে গোকুল ঢুলি মাত্র ২০ টাকায় নিজেকে বিক্রি করেন।

দলিল সম্পাদনের তারিখ ২ বৈশাখ ১১২১ বঙ্গাব্দ। দলিল লেখকের নাম শ্রীরামচন্দ্র বৈতজ্ঞ। এ কাহিনী রেকর্ডরুমের দলিলে রয়েছে। একসময় বিক্রমপুর দাস বিক্রি এবং নারী বেচাকেনার হাটে পরিণত হয়েছিল। মুদি ও মনিহারি পণ্যের মতো সুন্দরী রমণী নৌকায় করে। গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ক্রয়- বিক্রয় করা হত।   

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.