গায়ত্রী মন্ত্রের প্রকৃত মহিমা কী? কারাই বা এই মন্ত্র উচ্চারণের অধিকারী?

Odd বাংলা ডেস্ক: যে কোনও অবসরে ভারতের যে কোনও জায়গায় আপনার কানে আসতে পারে গায়ত্রী মন্ত্র। ৯০ মিনিট ধরে লাগাতার গায়ত্রী উচ্চারণকে এইমুহূর্তে ‘ভাইরাল’ বললে কম বলা হয়। এই অবস্থায় অনেকের মনেই প্রশ্ন— গায়ত্রীকে কি এইভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করাটা ঠিক? যুগ যুগ ধরে বর্ণবিভক্ত হিন্দু সমাজ গায়ত্রীর উপরে ব্রাহ্মণ সমাজের একাধিপত্য চাপিয়ে রেখেছিল। প্রযুক্তির কল্যাণে তার এই গণতন্ত্রীকরণকে অনেক রক্ষণশীলই ভাল চোখে দেখেননি। তদুপরি, এক বড় অংশের ভারতীয় সমাজ গায়ত্রীকে হিন্দু ধর্মের একান্ত বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন। সেটাও ঠিক নয়। কেউ কি ভেবে দেখেন, ঠিক কী বলতে চায় গায়ত্রী মন্ত্র? আর একে উচ্চারণের অধিকারী ঠিক কারা?

• প্রথমেই জানা দরকার, গায়ত্রী মন্ত্র উল্লিখিত হয়েছে ঋগ্বেদে। বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থের কোথাও ‘হিন্দু’ শব্দটাই উল্লিখিত নয়। ঋগ্বৈদিক সভ্যতা ছিল অপৌত্তলিক প্রকৃতি-উপাসক। গায়ত্রী এই উপাসনা পদ্ধতিরই অন্যতম প্রধান মন্ত্র।

• ‘ওঁ ভূর্ভুবস্ব তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গোদেবস্য ধীমহি ধীয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ’— এই মন্ত্রে যে যে দেবতা উল্লিখিত হয়েছেন, তাঁদের নামগুলি দেখা যাক। ‘ওঁ’ পরব্রহ্ম, ‘ভূ’ অর্থাৎ পৃথিবীলোক, ‘ভুবঃ’ আকাশলোক, ‘স্ব’ স্বর্গ। এখানে এই ত্রিলোকের অধিপতি পরমের কথা বলা হয়েছে। ‘তৎ’-এর অর্থ চূড়ান্ত সত্য, ‘সবিতু’ অর্থে যাবৎ কিছুর উৎস। ‘বরেণ্যম’ অর্থাৎ এঁদের প্রণাম করা হচ্ছে। ‘ভর্গো’ শব্দের অর্থ আধাত্ম্যশক্তি, ‘দেবস্য’ দৈব সত্তা। এবং সেখানে ‘ধীমহি’ অর্থাৎ ধ্যান করা হচ্ছে। ‘ধীয়ো’ অর্থে ধীশক্তি বা বৌদ্ধিক উৎকর্ষ, ‘প্রচোদয়াৎ’-এর অর্থ আলোকপ্রাপ্তি।


• প্রকৃতি উপাসক আর্য সভ্যতা গায়ত্রী মন্ত্রকে প্রকৃতির পরমতম রূপের উদ্দেশেই নিবেদন করেছিল। পরম্পরাগত বিশ্বাস, মহর্ষি ভৃগু এর রচয়িতা।

• স্বামী বিবেকানন্দ গায়ত্রী মন্ত্রের অনুবাদ করেছিলেন— আমরা সেই মহতের উপাসনা করছি, যিনি এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা। তিনি যেন আমাদের আলোকপ্রাপ্তির পথে নিয়ে যান।

• গায়ত্রী মন্ত্রকে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখার কাজটা সম্পন্ন হয় সম্ভবত গুপ্তযুগে। আসলে এই মন্ত্র ‘দ্বিজ’-দের উচ্চারণের যোগ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। প্রাচীন আর্য সমাজে ব্রাহ্মণরাই একা দ্বিজ ছিলেন না। দ্বিজত্ব অর্জন করা যেত কর্মের দ্বারা।

• গায়ত্রী ছন্দকে শ্রেষ্ঠ ছন্দ বলে বর্ণনা করেন আর্য ছান্দসিকরা। এই ছন্দে এই মন্ত্র গীত হয়। সঠিকভাবে ঊষালগ্নে এই মন্ত্র উচ্চারণের বিধান রয়েছে। বলাই বাহুল্য, ঊষালগ্নের শুদ্ধতার কথা স্বীকার করে পৃথিবীর সব ধর্মমত।

গায়ত্রী মন্ত্র হল বৈদিক হিন্দুধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বেদের অন্যান্য মন্ত্রের মতো গায়ত্রী মন্ত্রও "অপৌরষেয়" (অর্থাৎ, কোনো মানুষের দ্বারা রচিত নয়) এবং এক ব্রহ্মর্ষির কাছে (গায়ত্রী মন্ত্রের ক্ষেত্রে ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র) প্রকাশিত। এই মন্ত্রটি বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এটি ঋগ্বেদের (মণ্ডল ৩।৬২।১০) একটি সূক্ত। গায়ত্রী মন্ত্র গায়ত্রী ছন্দে রচিত। হিন্দুধর্মে গায়ত্রী মন্ত্র ও এই মন্ত্রে উল্লিখিত দেবতাকে অভিন্ন জ্ঞান করা হয়। তাই এই মন্ত্রের দেবীর নামও গায়ত্রী। গায়ত্রী মন্ত্র দিয়ে শুধু পূজাই হয় না, গায়ত্রী মন্ত্রকেও পূজা করা হয়।

গায়ত্রী মন্ত্র দিয়ে হিন্দু দেবতা সবিতৃকে আবাহন করা হয়। তাই গায়ত্রী মন্ত্রের অন্য নাম "সাবিত্রী মন্ত্র"। সাবিত্রীর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা অনুসারে এই মন্ত্র সূর্যপূজা, যোগ, তন্ত্র বা শাক্তধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।


মন্ত্রটির শুরুতে ওঁ-কার এবং "মহাব্যাহৃতি" নামে পরিচিত "ভূর্ভুবঃ স্বঃ" শব্দবন্ধটি পাওয়া যায়। এই শব্দবন্ধটি তিনটি শব্দের সমষ্টি - ভূঃ, ভূবঃ ও স্বঃ। এই তিনটি শব্দ দ্বারা তিন জগতকে বোঝায়। ভূঃ বলতে বোঝায় মর্ত্যলোক, ভূবঃ বলতে বোঝায় স্বর্গলোক এবং স্বঃ হল স্বর্গ ও মর্ত্যের সংযোগরক্ষাকারী এক লোক। বেদে যে সপ্তভূমি বা সাত জগতের উল্লেখ আছে, এগুলি তার মধ্যে তিনটি জগতের নাম। ধ্যান অনুশীলনের ক্ষেত্রে ভূঃ, ভূবঃ ও স্বঃ - এই তিন লোক চেতন, অর্ধচেতন ও অচেতন - এই তিন স্তরের প্রতীক।

বৈদিক সাহিত্যে বহুবার গায়ত্রী মন্ত্র উল্লিখিত হয়েছে।[৩] মনুস্মৃতি,[৪] হরিবংশ,[৫] ও ভগবদ্গীতায়[৬][৭] গায়ত্রী মন্ত্রের প্রশংসা করা হয়েছে। হিন্দুধর্মে উপনয়ন সংস্কারের সময় গায়ত্রী দীক্ষা একটি প্রধান অনুষ্ঠান এবং হিন্দু দ্বিজ সম্প্রদায়ভুক্তেরা এই মন্ত্র নিত্য জপ করেন। আধুনিক হিন্দু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে গায়ত্রী মন্ত্র নারী ও সকল বর্ণের মধ্যে প্রচলিত হয়েছে।[৮][৯]

গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণের আগে ওঁ-কার উচ্চারণ করা হয়। তারপর "মহাব্যাহৃতি" নামে পরিচিত "ভূর্ভূবঃ স্বঃ" শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করা হয়। তৈত্তিরীয় আরণ্যক (২। ১১। ১-৮) অনুযায়ী, ধর্মগ্রন্থ পাঠের আগে ওঁ-কার, মহাব্যাহৃতি ও গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়।[১১] মহাব্যাহৃতির পরে ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে উক্ত (৬২।১০) মূল মন্ত্রটি পাঠ করা হয়।

গায়ত্রী ছন্দে আটটি শব্দাংশ-যুক্ত মোট তিনটি পাদ থাকে। কিন্তু ঋগ্বেদ সংহিতায় উল্লিখিত গায়ত্রী মন্ত্রে একটি শব্দাংশ কম। এই মন্ত্রের প্রথম পাদে সাতটি শব্দাংশ। তাই তিন-শব্দাংশযুক্ত "বরেণ্যং" শব্দের পরিবর্তে "বরেণীয়ং‌" শব্দটির দ্বারা শব্দাংশের সংখ্যায় সমতা আনা হয়।

সবিতা

গায়ত্রী মন্ত্রের দেবতা সবিতা। ঋগ্বেদের ২য় মন্ডলের ৩৮ সূক্তের ৭ থেকে ১১ নং মন্ত্রে সূর্য বা সবিতাকে সকল শক্তির উত্স বলে তার স্তুতি করা হয়েছে। এই মন্ত্রে বলা হয়েছে, হে সবিতা, তুমি অন্তরীক্ষ, জল, স্থল সকল কিছু সৃষ্টি করেছ। তুমি সকল ভূত, পশুপাখী, স্থাবর জঙ্গম ইত্যাদিকে স্ব স্ব স্থানে রেখেছ। ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অর্য্যমা বা রুদ্র সবাই তোমার শক্তিতে বলীয়ান। কেউ তোমাকে হিংসা করে না। হে পরমেশ্বর, তোমার দুতিমান জ্যোতিকে (অথ্যাৎ, সকল প্রকাশ যুক্তশক্তি এবং অপ্রকাশিত অতিন্দ্রিয় শক্তিকে) আমরা নমষ্কার করি। তুমি সকলের কল্যাণ কর। আমাদের জন্যে যেন সকল কিছু শুভ হয়। এটাই এই গায়ত্রী মন্ত্রের দেবতা সবিতার তাত্পর্য। বেদভাষ্যকার সায়নাচার্য গায়ত্রী মন্ত্রে সূর্য ও সবিতার দুই রকম অর্থ করেছেন। তাঁর মতে এই মন্ত্রে সবিতা হল, সকল কারণের কারণ সেই সচ্চিদানন্দ নিরাকার পরম ব্রহ্ম বা জগত স্রষ্টা। "সু" ধাতু থেকে সবিতৃ নিষ্পন্ন হয়েছে, যায় জন্যে সবিতার অর্থ এক্ষেত্রে প্রসবিতা বলে উল্লিখিত হয়েছে। নিরুক্তিকার যস্ক এর অর্থ করেছেন "সর্ব্বস্য প্রসবিতা।

অনুবাদ

গায়ত্রী মন্ত্রটির সরলার্থ, সর্বলোকের প্রকাশক সর্বব্যাপী সবিতা মণ্ডল জগৎ প্রসবকারী সেই পরম দেবতার বরেণ্য জ্ঞান ও শক্তি ধ্যান করি; যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রদান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্ত্রের নিম্নলিখিত অনুবাদ করেনঃ

 যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে পৃথিবী আকাশ তারা ,

 যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে বুদ্ধি চেতনা ধারা

— তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি"। 

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই মন্ত্রে পদ্যে যে বঙ্গানুবাদ করেন সেটি হল,

তিমির-রূপিনী নিশা – সবিতা-সুন্দর!

   সে তিমিরে তোমার সৃজন,

বিমল উজল আলো’ সৌন্দর্য-আধার!

   ফুল্ল-ঊষা – অপূর্ব-মিলন।

কুসুমিতা বসুন্ধরা-

   দ্যু-লোক আলোক-ভরা-

   জনয়িতা-সবিতা-সবার!

বরণীয়-রমণীয় নিত্য জ্ঞানাধার! (সবিতা)

গায়ত্রী


গায়ত্রী মন্ত্রের মূর্তিকল্প

দেবী গায়ত্রীর তিন রূপ। সকালে তিনি ব্রাহ্মী; রক্তবর্ণা ও অক্ষমালা-কমণ্ডলুধারিনী। মধ্যাহ্নে বৈষ্ণবী; শঙ্খ, চক্র, গদা ধারণকারিনী। সন্ধ্যায় শিবানী; বৃষারূঢ়া, শূল, পাশ ও নরকপাল ধারিনী এবং গলিত যৌবনা। শব্দ-কল্পদ্রুম অনুসারে, যজ্ঞকালে একবার ব্রহ্মার স্ত্রী সাবিত্রী একা যজ্ঞস্থলে আসতে অস্বীকৃত হলে, ব্রহ্মা ক্রুদ্ধ হয়ে অন্য নারীকে বিবাহ করে যজ্ঞ সমাপ্ত করার পরিকল্পনা করেন। তাঁর ইচ্ছানুসারে পাত্রী খুঁজতে বের হয়ে এক আভীরকন্যাকে (গোয়ালিনী) পাত্রী মনোনীত করেন ইন্দ্র। বিষ্ণুর অনুরোধে তাঁকে গন্ধর্ব মতে বিবাহ করেন ব্রহ্মা। এই কন্যাই গায়ত্রী।

গায়ত্রীর ধ্যানে আছে, তিনি সূর্যমণ্ডলের মধ্যস্থানে অবস্থানকারিনী, বিষ্ণু বা শিবরূপা, হংসস্থিতা বা গরুড়াসনা বা বৃষবাহনা। তিনি একাধারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। হিন্দু বিধান অনুসারে, সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় গায়ত্রী ধ্যান করতে হয় এবং এই মন্ত্র ধ্যান বা পাঠে মুক্তি প্রাপ্ত হয় বলে এর নাম ‘গায়ত্রী’। বেদজ্ঞ আচার্যের কাছে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হলে তাঁর পূণর্জন্ম হয় ও তিনি দ্বিজ নামে আখ্যাত হন। সেই কারণে দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণগণের উপাস্য। বৈদিক গায়ত্রী মন্ত্রে আদলেই অন্যান্য দেবতার গায়ত্রী রচিত হয়েছে, দ্রষ্টব্য গণেশ, কালী, গুহ্যকালী, নারায়ণ, রাধা প্রভৃতি ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.