এই মাছ খেলেই মৃত্যু অবধারিত!
Odd বাংলা ডেস্ক: পটকা মাছ নামে আমাদের কাছে পরিচিত হলেও ইংরেজিতে এর নাম ব্লো ফিশ। স্থানীয়ভাবে এটি পটকা, টেপা কিংবা বেলুন মাছ নামেও পরিচিত। দেখতে গোবেচারা টাইপের হলেও মাছটি অত্যন্ত বিষাক্ত। আমাদের দেশে খাল বিলে এই নাছ পাওয়া গেলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমুদ্রে দেখা মেলে এর।
আমাদের দেশের জেলেদের অনেকেরই এই মাছ সম্পর্কে তেমন ধারণাই নেই। সাধারণ মাছ হিসেবে কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলেন। বাজারেও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে পটকা মাছ। বিষাক্ত এ মাছ খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা মারা যায়। আর তখন পত্রিকায় খবর বের হয় ‘পটকা মাছ খেয়ে দেশের অমুক জায়গায় এতজন অসুস্থ কিংবা মৃত।’ দেশে পটকা মাছ খেয়ে মৃত্যুর মিছিল ক্রমে বাড়ছে। অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও দরিদ্রতাই মূলত এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাপানে সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় এই মাছ। সেদেশে এই মাছের বিভিন্ন পদ রান্না করে খাওয়া হয়। তবে বিষাক্ত হলেও তাদের এই মাছ কাটার ধরণ থাকে আলাদা। বিশেষ উপায়ে এই মাছের বিষাক্ত অংশটুকু ফেলে বাকিটুকু খাওয়া হয়। শুধু মাত্র পটকা মাছ কাটা আর রান্নার পদ্ধতি শিখতে জাপানে রয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ।
জাপানে সামুদ্রিক পটকা মাছ একটি দামি, সুস্বাদু ও অভিজাত শ্রেণির মাছ হিসেবে পরিচিত। পটকা মাছ তাদের ঐতিহ্যের অংশ। জাপানিরা বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে তাদের পটকার কোন প্রজাতি কোন সময় বিষাক্ত তা ইতিমধ্যে জেনে গেছে। পটকার মেন্যু তৈরির জন্য তাদের রয়েছে লাইসেন্সধারী বিশেষ শেফ। তবুও পটকা মাছ খেয়ে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, চীন, মেক্সিকো ইত্যাদি দেশেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। যদিও সে সংখ্যা এখন একেবারেই হাতেগোনা।
তবে কী কারণে পটকা মাছ বিষাক্ত এবং কেনই বা এই মাছটি খাদ্য তালিকা থেকে চিরতরে বয়কট করা উচিত। চলুন জেনে নেয়া যাক সেসব- বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের পটকা মাছ পাওয়া যায়। স্বাদু জলের পটকা ও লোনা জলের পটকা। স্বাদু জলের পটকা আকারে লোনা জলের পটকার চেয়ে অনেক ছোট। আমাদের স্বাদু জলে দুই প্রজাতির পটকা পাওয়া যায়। উভয় প্রজাতির পটকাই কমবেশি বিষাক্ত।
প্রজনন মৌসুমে পটকা মাছ অধিক বিষ বহন করে। পটকার চামড়া ও গোনাডে সাধারণত অধিক বিষ থাকে। পটকা মাছের বিষাক্ততা অঙ্গ, প্রজাতি, স্থান ও ঋতুভেদে ভিন্নতর হয়। পটকা মাছের শরীর আস্ত এটা বিষের থলি। টেট্রোডোটক্সিন নামে এক বিবশকারী বিষ আছে পটকায়। এই বিষ কারও শরীরে ঢুকলে মৃত্যু অবধারিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে পটকা মাছের যে প্রজাতিটি মারাত্মক বিষাক্ত জাপানে সেটা ততটা বিষাক্ত নাও হতে পারে।
মাছের বিষের পরিমাণ নির্ভর করে এর লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং মৌসুমের ওপর। প্রজননের অব্যবহিত পূর্বে এবং প্রজননকালীন সময়ে এতে অপেক্ষাকৃত বেশি বিষ থাকে এবং পুরুষ থেকে স্ত্রীজাতীয় মাছ বেশি বিষাক্ত। কারণ অ-কোষ থেকে ডিম্বাশয় বেশি বিষাক্ত। তবে বৈশাখ মাসে যে পটকা মাছটি বিষাক্ত, কার্তিক মাসে তাতে ততটা বিষ নাও থাকতে পারে। এলাকাভেদে বিষাক্ততার তারতম্যের জন্যেও একই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এ বিষের ফলে মানুষের জিহ্বা এবং ঠোঁটের স্বাদ নেয়ার ক্ষমতা থাকে না, মাথা ঘোরে ও বমি হয় এবং পরবর্তীতে শরীর অসাড় হয়ে আসে। সারা শরীর ঝিনঝিন করে, হ্নদস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তচাপ কমে যায় এবং মাংসপেশী অসাড় হয়ে পড়। ডায়াফ্রাম অসাড় হয়ে যাওয়ার ফলে শ্বাসতন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়। তবে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার বেশি যে জীবিত থাকে সে সাধারণত বেঁচে যায়।
সামুদ্রিক ও স্বাদু জলের পটকার ক্ষেত্রে মানুষের জন্য বিষাক্ততার মাত্রা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ১০ মাউস ইউনিট (এমইউ, বিষাক্ততার একক) অর্থাৎ, পটকার প্রতি ১ গ্রাম অংশে যদি ১০ এমইউ বিষ থাকে তবে তা মানুষের জন্য বিষাক্ত। এ পরিমাণ বিষ খেলে তার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হবে এবং এভাবে যদি একসঙ্গে ১০ হাজার এমইউ বিষ একজন সুস্থ-সবল মানুষ খেয়ে ফেলে তবে নির্ঘাত মৃত্যু।
একইভাবে স্বাদু জলের পটকার ক্ষেত্রে প্রতি গ্রামে ৩ এমইউ বিষ থাকলে তা বিষাক্ত এবং ৩ হাজার এমইউ একসঙ্গে খেলে মৃত্যু অবধারিত। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে সামুদ্রিক পটকার চেয়ে স্বাদু জলের পটকা অধিকতর বিষাক্ত। উপরন্তু, পটকার মধ্যে কোনটি বিষাক্ত এবং কোনটি বিষাক্ত নয় এবং কোনোটি কোনো সময়ে বিষাক্ত এ ধরনের যথেষ্ঠ তথ্য আমাদের জানা নেই। স্থানভেদে বিষাক্ততার তারতম্য কতটুকু তাও আমরা জানি না। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে পটকা মাছ খাওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকাই উত্তম।
বাংলাদেশে পটকা মাছের ১৩টি প্রজাতি আছে যাদের দুটি মিঠা জলের এবং বাকীগুলো সমুদ্রে বাস করে। পটকা মাছের বিষ টেট্রোডোটক্সিন(টিটিএক্স) একটি শক্তিশালী বিষাক্ত পদার্থ যা মানুষের উত্তেজক (এক্সাইট্যাবল) সেল মেমব্রেনের সোডিয়াম চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম।
মাছের বিষাক্ত পদার্থটি তার যকৃত, ডিম্বাশয়, অন্ত্র এবং চামড়ার মধ্যে খুব বেশি ঘনীভূত থাকে, তবে শরীরের পেশীসমূহ সাধারণত বিষমুক্ত থাকে। সব পটকা মাছই বিষাক্ত নয়। কিছু আছে যেগুলো হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বিষাক্ত, যদিও প্রত্যেক প্রজাতির পটকা মাছের বিষের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদন বাংলাদেশে নেই।
পটকা মাছ দেখতে একেবারেই গোবেচারা টাইপের। বিপদে পড়লে কিংবা উত্তেজিত হলে জলখেয়ে অথবা পেটে বাতাস ঢুকিয়ে এরা ফুটবলের আকৃতি ধারণ করতে পারে। টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো অত্যন্ত শক্তিশালী দু’পাটি দাঁত আছে এদের। এই দাঁতের সাহায্যে এরা শিকারকে কাবু করে ফেলে। এদের শিকার সাধারণত শামুক, ঝিনুক, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি। পটকা মাছ খুব একটা সাঁতার কাটতে পারে না। জলের এরা অলস ভঙ্গিতে চলাফেরা করে।
Post a Comment