স্বপ্ন জয়ের স্বপ্ন দেখেন তারা, শারীরিক অক্ষমতা হতে পারেনি বাধা
Odd বাংলা ডেস্ক: শারীরিক প্রতীবন্ধকতা কোনো কাজের বাধা হতে পারে না। স্বপ্ন পূরণের জন্য চাই কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর মনোবল। এগুলোর উপর আস্থা রেখেই অনেকেই পৃথিবী জয় করেছেন। যাদের জন্ম দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল পরিবারকে। সমাজের একটি আলাদা অংশ ছিল যারা।
বলছিলাম শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও যারা আজ সাধারণ মানুষের কাতারে সামিল হয়েছে নিজেদের যোগ্যতায়। নিজের চেষ্টা আর দৃঢ় মনোবল তাদের এতো দূর আসতে সহায়তা করছে। সারাবিশ্বে বছরের একটি দিন তাদের উদ্দেশ্য করে পালন করা হয়। প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বরকে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগীতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকান্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই এই দিবসটির সূচনা।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী দিবসের অনুগামিতার পিছনে আছে এক ঘটনাবহুল জীবনস্মৃতি। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বেলজিয়ামে এক সাংঘাতিক খনি দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যান। আহত পাঁচ সহস্রাধিক ব্যক্তি চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাদের প্রতি সহমর্মিতায় ও পরহিতপরায়ণতায় বেশ কিছু সামাজিক সংস্থা চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে স্বতঃপ্রবৃত্ত ভাবে এগিয়ে আসে। এর ঠিক পরের বছর জুরিখে বিশ্বের বহু সংগঠন সম্মিলিত ভাবে আন্তর্দেশীয় স্তরে এক বিশাল সম্মেলন করেন।
সেখান থেকেই প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্যের হদিশ মেলে। সেখানে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবন্ধী কল্যাণে বেশকিছু প্রস্তাব ও কর্মসূচি গৃহীত হয়। খনি দুর্ঘটনায় আহত বিপন্ন প্রতিবন্ধীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালন করতে আহ্বান জানানো হয়। সেই থেকেই কালক্রমে সারা পৃথিবীর প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দিন হয়ে উঠেছে।
এর অনেক প্রমাণ রয়েছে আমাদের দেশেও। এদের মধ্যে একজন বেলাল উদ্দিন। যিনি মনের জোড়েই নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিশ্ব জয় করেছেন। দুই হাতে ভর করে চলছেন একাকী। ১৯৯৩ সাল, বেলালের বয়স তখন ১৩ বছর। বন্ধুদের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে যাবার পথে নেমে আসে এক দুঃস্বপ্ন। ট্রেনে কাটা পড়ে চিরতরে হারান দুটি পা।
চলার মতো অবলম্বন নেই তার। তারপরও থেমে যাননি। ২০০০ সালে বাবাকে হারিয়ে একা হয়ে পরলেও, পঙ্গুত্ব নিয়েই বেলালকে ধরতে হয় সংসারের হাল। পানের দোকান থেকে শুরু করে বিক্রি করেছেন সবজিও। গত বছর নগরীর বায়েজীদের রৌফাবাদে একটি অস্থায়ী দোকান দেন অদম্য এই যুবক। যেখানে মোবাইলের পাশাপাশি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মেরামত করেন তিনি। তাতেই চলে মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানসহ ৫ সদস্যের একটি পরিবার।
বেলাল উদ্দিনের বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি থাকলেই প্রতিবন্ধীরাও পারে অনেক কিছু করতে। কারো করুণার পাত্র না হয়ে থাকতে চেয়েছেন বেলাল। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীরা ভিক্ষা না করে যদি কোনো কাজ করে খাই, তবে আমাদের দেশ আরো উন্নতি হবে।
আরেকজন বুক থেকে পা পর্যন্ত প্যারালাইজড। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে হুইল চেয়ারের সাহায্যে চলাফেরা করছেন হেদায়তুল আজিজ মুন্না। তবুও থেমে নেই তার জীবন। হুইল চেয়ারে বসেই লড়ছেন, অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন সকল প্রতিবন্ধীদের।
প্রতিবন্ধীত্ব তার কাছে প্রতিবন্ধকতা নয় বরং এগিয়ে চলার শক্তি। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই যুবক নিজের যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে সুস্থ-সবলদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন প্রতিবন্ধীরা বোঝা নয় বরং সম্পদ। ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্মাননা লাভ করেন মুন্না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে সম্মানা স্মারক তুলে দেন।
মুন্না একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিয়ে ২০০৩ সালে সৌদি আরব যান তিনি। সেখানে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও ছিল তার। চাকরি-ব্যবসা মিলিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরির ফলে পঙ্গু হতে হয় তাকে। তখনই হয়তো তার জীবন থেমে যেতে পারত। কিন্তু মুন্নার ইচ্ছাশক্তি তাকে নিয়ে গেছে সাফল্যের শিখরে।
দুর্ঘটনার পর ২২ দিন কোমায় ছিলেন মুন্না। পরবর্তীতে পারিবারের সিদ্ধান্তে তাকে দেশে এনে প্রথমে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর সাভারের সিআরপিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তার মনোবলের কাছে হেরে যায়। ক্রীড়া খাতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন থেকে একটি হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও অর্জন করে ওই ক্রিকেট দলটি। দলটির একজন অন্যতম সদস্য মুন্না।
শারীরিক অক্ষমতা প্রতিবন্ধকতা হতে পারেনি ময়মনসিংহ শহরেও। সেখানকার ‘কাঁচিঝুলি প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার’গেলে বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করা যায়, প্রতিবন্ধীরা সমাজের জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। তাদের তৈরি শতরঞ্জি ও হস্তশিল্পের বিভিন্ন পণ্য এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কাঁচিঝুলিতে প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার মহিলা ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। সেই থেকে প্রতিবন্ধী নারীরা হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে ১৭ জন প্রতিবন্ধী নারীকে নিয়ে চলছে শতরঞ্জি তৈরির কাজ।
Post a Comment