১৮০ ডিগ্রি মাথা ঘুরিয়ে চা পান, জন্মত্রুটিই এনে দিয়েছে তাকে জনপ্রিয়তা
Odd বাংলা ডেস্ক: বিশ্বে অনেক উদ্ভট মানুষ দেখেছেন। তবে তাদের মধ্যে অনেককে আবার প্রতিভাবান বলেও বলা যায়। পৃথিবীতে মানুষ নানা প্রতিভা নিয়ে জন্মে থাকে। কারো কারো এমন প্রতিভা আছে যা শুনলে যে কেউ বিস্মিত হবে। আচ্ছা তোমাদেরকে যদি বলি তোমরা তোমাদের মাথা পেছনের দিকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরাতে পারবে? ভাবছেন নিশ্চয় কোনো ভূতের কোনো সিনেমার গল্প বলছি।
আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় দেড়শ বছর আগে। ১৮৮৫ সালের কথা। জার্মানির নুরেমবার্গে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত শিশু। আজকাল যাকে বলা হয় জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়া শিশু। শিশুটি জন্মের পর পরই চিকিৎসকরা দেখলেন তার স্পাইনাল কর্ড অনেকখানি বাঁকা হয়ে পাকিয়ে রয়েছে। আর এই পাকানো স্পাইনাল কর্ডই তার ঘাড়কে প্রচুর পরিমাণে নমনীয়তা প্রদান করে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, যখন তিনি তার মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে আনতেন, তখন তার স্পাইনাল কর্ড দেখতে প্রশ্নবোধক চিহ্নের (?) মতো হয়ে থাকত।
পরবর্তিতে এই শিশু দেশে বিদেশে অনেক নাম করেছিলেন। ঠিক যেমন প্যাঁচা তার মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের পিঠ চুলকাতে পারে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে অন্তত একজন মানুষ ঠিক এই প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন—যিনি তার মাথা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে একদম পেছনের দিকে নিয়ে যেতে পারেন। মানে তার শরীর ঠিকই সামনের দিকে থাকছে, আর মাথা ঘুরে আছে পেছনের দিকে। আর এ কারণেই তাকে বলা হতো হিউম্যান ওল। ওল মানে হলো প্যাঁচা। এই মানুষটির নাম মার্টিন জো লরেলো।
বর্তমানে ফটোশপের মাধ্যমে এমনটা দেখা গেলেও মার্টিন জো লরেলো সত্যিকার অর্থে নিজেই নিজের মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে আনতে পারতেন। এটা তিনি সম্ভব করেছেন এ ধরনের টেলিভিশন সিরিজ বা সিনেমা প্রচার হবার বহু আগেই! মার্টিন জো লরেলো জন্মের পর থেকেই কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে পুরোটা পেছনের দিকে আনতে পারতেন না। পুরোপুরি পেছনে আনতে তাকে অনেক পরিশ্রম এবং চর্চা করতে হয়েছে। তার এই অস্বাভাবিকতাকে কাজে লাগানোর জন্য লরেলো প্রায় তিন বছর বিভিন্ন ধরনের চর্চা করে গেছেন।
তার মধ্যে কিছু চর্চা ছিল শুধু তার ঘাড়ের মেরুদণ্ডের কিছু হাড়কে স্থানচ্যুত করা, যাতে তিনি তার মাথাটা ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ পেছনের দিকে আনতে পারেন! এতে তিনি সফলও হয়েছেন। এই অস্বাভাবিকতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন বিভিন্ন সার্কাসে মানুষকে বিনোদন দেওয়ার মাধ্যমে। তবে কিছুটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মাথা পেছনে থাকা অবস্থায় তিনি মুখ দিয়ে যেকোনো তরল যেমন- পানি, জুস ইত্যাদি পান করতে পারতেন, কিন্তু কোনোভাবেই নিঃশ্বাস নিতে পারতেন না।
পূর্বে লরেলোর সময়ে মানুষের বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিল বিভিন্ন ধরনের সার্কাস। সেসব সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে থাকতো বিভিন্ন ধরনের সার্কাস খেলোয়াড়। তাদের মধ্যে থাকতো অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা। পাশাপাশি আরো কিছু মানুষ থাকতেন, যারা তাদের দৈহিক বিকলাঙ্গতার কারণে অদ্ভুত সব শারীরিক দক্ষতা দেখাতে পারতেন। তাদের এই সার্কাসগুলোকে বলা হত ‘সাইড-শো’। অর্থাৎ প্রধান সার্কাস প্রদর্শনীর পাশাপাশি বিকলাঙ্গ ব্যক্তিদের অদ্ভুত সব শারীরিক দক্ষতা দেখানোরও ব্যবস্থা থাকতো।
তখনকার সমাজে এ ধরনের ব্যক্তিদের কদাকার হিসেবেই বিবেচনা করা হতো, যার ফলে তারা বিভিন্ন সার্কাসের সংগঠনেই নিজেদের ঠিকানা খুঁজে নিতেন। সার্কাসই একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল তাদের জন্য যেখানে তারা তাদের এই দৈহিক বিকলাঙ্গতাকে লাভজনক প্রদর্শনীতে পরিণত করতে পারতেন। মার্টিন লরেলোও নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছিলেন এক সার্কাস দলে।
সার্কাসে অংশগ্রহণ করার পর তিনি আমেরিকার সর্বত্র তার এই শারীরিক দক্ষতা দেখিয়ে বেড়াতেন। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন একটি জার্মান-আমেরিকান সার্কাসের কৌশল-প্রদর্শক। অন্যান্য আরো পারফর্মারদের সঙ্গে তিনি ১৯২১ সালে জার্মানি থেকে আমেরিকায় চলে আসেন এবং বিভিন্ন সার্কাসপার্টিতে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে দেখতে একজন ফিটফাট মানুষই মনে হতো। কোনোভাবেই বোঝার উপায় ছিল না যে লরেলোর এমন অঙ্গবিকৃতি থাকতে পারে।
তিনি পারফর্ম করার সময় সর্বদা সাদা শার্ট পরতেন। কেন তিনি এই বিশেষ রঙের শার্টই পরতেন, সে সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। এমনকি তিনি বিভিন্ন কুকুরদের মাথা ঘোরানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। সেসব কুকুর লরেলোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মাথাও পেছনে ঘুরাতে পারতো। এসবের পাশাপাশি তিনি একজন ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
তবে এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে ছিল কিছু বিতর্ক। মার্টিন একইসঙ্গে জার্মান এবং আমেরিকান দুই দেশের নাগরিক ছিলেন। যদিও তার জীবনী নিয়ে খুব বেশি তথ্য সংগ্রহ করা নেই, তাকে ধরা হতো নাৎসি সমর্থক হিসেবে। তিনি নাকি আমেরিকার পতাকাকে মোটেও পছন্দ করতেন না! এ সম্পর্কে তার একজন সঙ্গী সার্কাস প্রদর্শক পারসিলা বারজানো বলেন, “মার্টিন এমারলিং থেকে নাম বদলিয়ে মার্টিন লরেলো করার কারণে এবং তার কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে সবাই তাকে একজন জার্মান সমর্থক হিসেবেই ধরতো।
যার কারণে তিনি তার নিকটাত্মীয় এবং আশেপাশে থাকা কারো কাছেই অতটা প্রিয়মুখ ছিলেন না”। শেষের দিকে তিনি তাই একরকম একাই হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি ১৯৩১ সালে তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছিলো তার স্ত্রী অ্যামেলিয়া এমারলিংকে পরিত্যাগ করার জন্য। অ্যামেলিয়া নিজে একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে বাল্টিমোর পুলিশ ডিপার্টমেন্টে এই অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
তার সর্বশেষ যে সার্কাস প্রদর্শনী রেকর্ড করা হয়েছিল, তা হচ্ছে ১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ। প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘ইউ আস্কড ফর ইট’। লরেলোর সার্কাস প্রদর্শনীগুলো ছাড়া তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানাও যায় নি। ১৯৫৫ সালে ৭০ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে তিনি মারা যান।
Post a Comment