চীনের কয়েকশো কিলোমিটার ছেয়ে গেছে রোডোডেনড্রন ফুলে

Odd বাংলা ডেস্ক: রোডোডেনড্রনের নাম শুনেই হয়ত অনেকের রবীন্দ্রনাথের শেশের কবিতার সেই লাইনটি মনে পড়ে গেছে। "পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি... উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ"। অমিত-লাবণ্যের শুভ্র রোম্যান্স কবিগুরু রাঙিয়েছিলেন রোডোডেনড্রনের রঙে।শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'বাঙালের আমেরিকা দর্শন' বইতেও পাওয়া যায় রডোডেনড্রনের কথা।

সম্প্রতি গত কয়েক দিনে চীনের কুইচৌ প্রদেশের বিচিয়ে শহরে কয়েকশ কিলোমিটারজুড়ে রোডোডেনড্রন ফুল ফুটেছে। আকাশ থেকে দেখলে বহুবর্ণ রংয়ের ফুল দারুণ সুন্দর লাগে। এ দর্শনীয় স্থান বিশ্বের বৃহত্তম ও ভালো সংরক্ষিত আদিম রোডোডেনড্রন বনাঞ্চল, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করছে।  

চীন ছাড়াও ইউরোপের আল্পস পর্বত, অস্ট্রেলীয় উপদ্বীপ, জাভা-সুমাত্রা, আমেরিকার উত্তরাংশ, এশিয়ার হিমালয় পর্বতভূমির ভারত, জাপান রডোডেনড্রনের চারণভূমি। বর্তমানে গোটা বিশ্বে প্রায় ১১০০ প্রজাতির রডোডেনড্রন রয়েছে। মূলত রডোডেনড্রন দেখা যায় পাহাড়,পর্বতে শীতল থেকে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার অঞ্চগুলোতে।

গ্রিক শব্দ ‘রডোন’-এর শব্দার্থ গোলাপ এবং ‘ডেনড্রন’ মানে গাছ। নামকরণ করেন ‘মর্ডান ট্যাক্সোনমি’র জনক কার্ল ফন লিনিয়াস তার ‘স্পেসিয়াস প্লানটেরিয়াম’গ্রন্থে (১৭৫৩ সাল)। এর পূর্বে এই ফুলকে ইউরোপে আলপাইন রোজ, আলপেন রোজ কিংবা স্নো রোজ বলা হতো। আমেরিকায় পরিচিত ছিল গ্রেট লরেল, সোয়াম্প হানিসাকেল নামে। এটি সাধারণত গুল্মজাতীয় গাছ, চিরহরিৎ এবং পত্রমূলাবর্ত অর্থাৎ গোলাকারে সুসজ্জিত দীঘলপত্র। ফুলটি পুষ্পমঞ্জরী, অর্থাৎ গুচ্ছাকার, কখনো সুরভিত। লাল, বেগুনি, সাদা রঙের ফুলই বেশি দেখা যায়। অ্যাজালিয়া প্রজাতির ক্ষেত্রে মূলত ফুল পাঁচটি পরাগধানীযুক্ত হয়।

রডোডেনড্রনের সঙ্গে ব্রিটেনের প্রথম পরিচয় ঘটে প্রবাদপ্রতিম উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ ক্যারোলাস ক্লুসিয়াসের (১৫২৬-১৬০৯) হাত ধরে। ইনি ছিলেন ব্রিটেনে বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপনের পুরোধাদের মধ্যে অন্যতম। আমেরিকায় রডোডেনড্রন শ্রেণিকরণ নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেন জন বারট্রাম (১৬৯৯-১৭৭৭)। ইনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেনের স্থপতি। ছেলে উইলিয়াম বারট্রামের (১৭৩৯-১৮২৩) সঙ্গে মিলিতভাবে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া, দক্ষিণ ক্যারোলিনার সামুদ্রিক অঞ্চল থেকে নানা প্রজাতির রডোডেনড্রন আবিষ্কার করেন। তার মধ্যে বেশ কিছু বীজ এবং চারা দেন পিটার কলিনসনকে (১৬৯৪-১৭৬৮)। কলিনসন ছিলেন ব্রিটেনে ‘রয়্যাল সোসাইটি’র অন্যতম সদস্য। তার ‘পেকহ্যাম গার্ডেন’, পরবর্তীকালে ‘দ্য মিল হিল গার্ডেন’ ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি ব্রিটেনের সেরা এবং দুষ্প্রাপ্য ফুলের বাগান। 

ষোড়শ-সপ্তদশ শতক থেকেই ইউরোপ, আমেরিকায় বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপিত হতে থাকে, এবং শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিডাইজেশন বা সংকরায়ণ। বিভিন্ন গাছ, গোলাপ, টিউলিপ ইত্যাদি ফুলসহ অভূতপূর্ব সৌন্দর্য্যের কারণে রডোডেনড্রনেরও চাহিদা বাড়তে থাকে। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল, চীন, বৃহত্তর ভারতবর্ষ ক্রমশ উঠে আসে অভিযাত্রীদের পছন্দের উপরের তালিকায়। ভারতে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয়রা আসতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে রডোডেনড্রন সংগ্রাহক হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলেন, ভারতীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত ড. উইলিয়াম রক্সবার্গ (১৭৫১-১৮১৫)। তিনি রডোডেনড্রনসহ প্রায় ৫০০০ ভারতীয় বৃক্ষের নমুনা তালিকাভুক্ত করেন। তার আসাম, সিকিম, ভুটান, ব্রহ্মদেশ (অধুনা মিয়ানমার) থেকে সংগৃহীত ৯,০০০ বৃক্ষের তালিকায় রয়েছে ভুটানের আটটি দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির রডোডেনড্রন।

তবে রডোডেনড্রনের বিশ্বজোড়া মুগ্ধতার নেপথ্যে রয়েছে ভারতের অঙ্গরাজ্য সিকিম এবং একজন স্যার জোসেফ ডাল্টন হুকার (১৮১৭-১৯১১)। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত সিকিমসহ হিমালয়ের গভীর পার্বত্য অরণ্য থেকে তিনি ৪৫টি বিরল প্রজাতির রডোডেনড্রন আবিষ্কার করেন এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.