বিপ্লবী এই নারীকে ১৯ বছর বয়সে পুড়িয়ে মারা হয় পুরুষের পোশাক পরার অপরাধে

Odd বাংলা ডেস্ক: জোয়ান অব আর্ক ইতিহাসের এক অবিসংবাদিত যোদ্ধা, সেনাপতি ও বিপ্লবী। ইংরেজদের সঙ্গে শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ এর (১৩৩৭-১৪৫৩) সময় তিনি ফ্রান্সের সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। ১৮০৩ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জোয়ান অব আর্ককে ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ১০৬ বছর ধরে যে ‘শত বছরের যুদ্ধ’ চলেছিল, তারই একটা সময়ে জোয়ান অব আর্ক যুদ্ধ করেছিলেন ফ্রান্সের হয়ে।

সেইন্ট ও অ্যাঞ্জেলদের স্বপ্নে দেখার কথা বলেছিলেন জোয়ান, যারা তাকে ষষ্ঠ চার্লসকে যুদ্ধে সহায়তা করে ইংল্যান্ডের অধীনস্ততা থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে বলেছিলেন। পুরুষের বেশ ধরে যুদ্ধে যান জোয়ান। চার্লস তাকে পাঠান অরলিন্স এ। টানা দেড় বছর ধরে ইংরেজরা যেখানে জিতে চলছিল, সেখানে জোয়ানের আগমনের মাত্র নয় দিনের মাথায় পরাজিত হয় তারা। এরপরে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করে জয় নিয়ে আসেন জোয়ান। জোয়ানের খণ্ডযুদ্ধগুলো জয়ের ঘটনা প্রবল উদ্যম ছড়িয়ে দেয় ফ্রেঞ্চ বাহিনীর মধ্যে।

মিউজ নদীর তীরে দঁরেমি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে ১৪১২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ফ্রান্স তখন ইংরেজদের শাসনাধীন ছিল। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরির(১৩৮৭-১৪২২) পুত্র ষষ্ঠ হেনরি (১৪২১-১৪৭১) ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করলে ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস পালিয়ে যান। বাবা জেক এর খামার থেকে তিনি কৃষি কাজ শেখেন এবং মা ইসাবেলর কাছ থেকে শেখেন সেলাইর কাজ। শৈশবে তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক একজন কিশোরী। তিনি এমন এক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধের কারণে চরম দরিদ্রতা বিরাজ করছিল।

শৈশবে তিনি খুব ধার্মিক জীবনযাপন করতেন। তবে বারো বছর বয়সে তিনি রহস্যময় জীবন শুরু করেন। কেননা তিনি বলতে থাকেন যে, তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে ফ্রান্সকে পুনর্গঠন করার নির্দেশ পেয়েছেন। জোয়ান লেখাপড়া জানতেন না। কথিত আছে, মাত্র তের বছর বয়সে মাঠে ভেড়ার পাল চড়ানোর সময় তিনি দৈববাণী শুনতে পান যে, তাকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও ফ্রান্সের প্রকৃত রাজাকে ক্ষমতায় পূনর্বহাল করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এই দৈববানী তার জীবনকে আমূল পালটে দেয়।

এরপর জোয়ান অনেক চেষ্টা করে ফ্রান্সের পলাতক রাজা সপ্তম চার্লসের সঙ্গে দেখা করেন এবং দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য তার কাছে সৈন্য প্রার্থনা করেন। রাজা প্রথমে অবজ্ঞা প্রদর্শন করলেও যাজক সম্প্রদায়ের পরামর্শে জোয়ানকে সৈন্যসাহায্য দিতে সম্মত হন। এই সময় বিখ্যাত ফরাসি ধর্মগুরু সেইন্ট মাইকেল ও সেইন্ট ক্যাথরিনের কাছ থেকে তিনি ফ্রান্সকে নেতৃত্ব দেয়ার উৎসাহ পান। জোয়ান সাদা পোশাক পরিধান করে একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে পঞ্চক্রুশধারী তরবারি হাতে ৪০০০ সৈন্য নিয়ে ১৪২৯ সালের ২৮শে এপ্রিল অবরুদ্ধ নগরী অরলেয়াঁয় প্রবেশ করেন।

প্রথম আক্রমণেই তারা জয়লাভ করেন এবং এরপর তাদের একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা ইংরেজ সৈন্যদের কবল থেকে তুরেলবুরুজ শহর উদ্ধার করেন। এরপর পাতে'র যুদ্ধেও ইংরেজরা পরাজিত হয়। জুন মাসে জোন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে রেইমস নগরী অধিকার করেন। এরপর ১৬ই জুলাই সপ্তম চার্লস ফ্রান্সের রাজা হিসেবে আবার সিংহাসনে অভিষিক্ত হন এবং এভাবে জোন ফ্রান্সকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দেন। জোনের মাধ্যমে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের মধ্যকার শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ অবসান ঘটে।

ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর ইংরেজরা জোয়ানকে জব্দ করার ফন্দি আঁটতে থাকে। ১৪৩০ সালের মে মাসে ইংরেজদের সহায়তাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান জোয়ান। ইংরেজদের কাছে তাকে হস্তান্তরের পর তারা তার বিচার শুরু করে। পিয়েরে কশন নামের এক বিশপ ছিল আদালতের বিচারক। কশন জোয়ানের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ আনে যার মধ্যে বড় একটি অভিযোগ ছিল জোয়ানের নারী-পুরুষ উভয়ের পোশাক পড়া! বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় জোয়ানের। তবে এটা জোয়ানের কতখানি অপরাধের তালিকায় পরে, তা নিয়েও কথা নয়নি তখন। 

বিচারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তিনি ইশ্বরের দয়ায় বিশ্বাস করেন কিনা।  জবাবে জোয়ান বলেছিলেন "যদি আমি তা না করি তবে ইশ্বর যেন আমাকে সেখানেই রেখে দেন, আর যদি বিশ্বাস করি তবে ইশ্বর যেন আমাকে রক্ষা করেন।" আসলে এই প্রশ্নটিই ছিল চালাকিপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ কেউ ইশ্বরের দয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনা। যদি জোয়ান বলতেন হ্যাঁ করি, তবে তাকে ধর্মের বিরুদ্ধে যাবার অভিযোগ আনতেন আর যদি জোয়ান বলতেন "না" তবে বলা হতো তিনি নিজের অভিযোগ নিজেই স্বীকার করেছেন।

ছলচাতুরি বিচারে আদালত তাকে ১২ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে। আইন সম্পর্কে অজ্ঞ জোয়ান তখন বুঝতে পারেননি যে আসলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে। সে সময় ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ার ছিল শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি। তাকে সে শাস্তি মৃত্যদণ্ডই দেয়া হয়েছিল। কারাগারে জোয়ান মেয়েদের পোশাক পরিধান করা শুরু করেন। এর ক'দিন পর তাকে কারাগারেই ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনার পর জোয়ান আবার পুরুষদের পোশাক পরিধান শুরু করেন। এর পেছনে মূল কারণ ছিল ছেলেদের পোশাকে নিরাপত্তা বেশি পাওয়া যেতে পারে আর তার পরার জন্য অন্য কোনো বস্ত্র অবশিষ্ট ছিলনা।

১৪৩১ সালের ৩০ মে জোয়ানকে যখন পুড়িয়ে মারা হয় তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। তাকে একটি পিলারের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। জোয়ান গীর্জার যাজকদের কাছে একটি ক্রুস চান। একজন চাষী একটি ছোট ক্রুস তৈরি করে জোয়ানের পোশাকের সামনে ঝুলিয়ে দেন। জোয়ানের মৃত্যুর পর ইংরেজরা তার কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরকে প্রদর্শন করে যাতে কেউ কোনোদিন দাবি না করতে পারে জোয়ান বেঁচে পালিয়ে গেছে। এরপর তার শরীর আরো দু'বার পোড়ানো হয়। ফলে তার ছাইগুলো এতো মিহি হয়ে যায় যে কেউ তা সংগ্রহ করতে পারে না। তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ফরাসিরা চিরতরে ফ্রান্সে ইংরেজদের সকল অধিকার ও চিহ্ন মুছে দেয়ার প্রয়াস পায়। ১৪৫৬ সালে পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাস এর নেতৃত্বে গঠিত একটি আদালতে জোয়ানকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.