Odd বাংলা ডেস্ক: ৫০০ কোটি বছর বয়সী পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশই পানিতে ঘেরা। আর এজন্যই হয়তো বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনযাত্রা অনেকাংশেই পানির উপর নির্ভরশীল। সেটা বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যসংস্থান হোক বা ব্যবসা বাণিজ্য, মানুষ চিরকাল নির্ভর করে এসেছে জলপথের উপর। সেই সুদূর মধ্যযুগে মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরীর বহু আগে সমুদ্রযাত্রা নিয়েঅনেক গল্পগাথা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে নানারঙের কাহিনি , রূপকথা।
স্থলে যোগাযোগ ব্যবস্থার আগে তৈরি হয়েছে জলপথ। সহজ এবং সস্তা হওয়ার কারণে জনপ্রিয়ও ছিল বেশি। রেলপথ, আকাশপথ তো সেদিনকার কথা, তার বহু আগে থেকেই মানুষের যে কোনো দরকারে একমাত্র ভরসা ছিল জলপথ- সমুদ্রপথ। আর সেই ভয়াল সমুদ্রপথে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায়ই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হত নাবিকদের। বিংশ শতাব্দীতে সব কিঙ্গু উন্নত হওয়ার পরও এমন অনেক সমস্যায় পড়তে হয় নাবিকদের। দিক ভুল করে অকুল দরিয়ায় পথ হারানো তো ছিলই, এছাড়া দিকনির্দেশের অভাবে সমুদ্রের মাঝে মাঝে জেগে থাকা ডুবো পাথর বা পাহাড়ে ধাক্কা লেগেও ধ্বংস হয়ে যেত বহু বাণিজ্যতরী। নষ্ট হত মূল্যবান জিনিসপত্র, অর্থ সম্পদ, প্রাণহানি ঘটত বহু মানুষের। নাবিকদের এই অসুবিধা দূর করতেই বোধহয় বাতিঘর বা লাইটহাউজের ধারণার জন্ম।
লাইটহাউজের ধারণার প্রবর্তন হয়নি যখন, তখনও থেমে থাকেনি বাণিজ্য। সভ্যতার সেই শুরুর দিকে নাবিকেরা ব্যবসার জন্যে সূর্যোদয়ের ঠিক মুখে মুখে ভেলা ভাসাতো সমুদ্রে, আর সূর্যাস্তের আগেই ডাঙা খুঁজে নিয়ে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করত প্রাণপণ। কিন্তু প্রকৃতি আপন খেয়ালে চলে। উত্তাল সমুদ্রের ভয়ংকর চেহারা আর অকল্পনীয় হিংস্রতার কাছে মানুষের শক্তি আর কতটুকু! সূর্যাস্তের আগে তাই অনেক সময় আশ্রয়ে ফেরা কঠিন হয়ে পড়ত। আলোর অভাবে যাতে তারা পথ ভুল না করে তাই অনেকসময় সমুদ্রতীরে বন্দরের কাছাকাছি বড় বড় মশাল জ্বালিয়ে রাখত গ্রামের মানুষ। আলো দিয়ে নাবিকদের এই পথ দেখানোর ধারণা থেকেই ক্রমে লাইটহাউজের সূচনা হয়।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন ফারো অফ আলেকজান্দ্রিয়াই ছিল এই পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম লাইটহাউজ। মিশরের সমুদ্রতীরে নির্মাণ করা হয়েছিল এটি। ধারণা করা হয় টলেমীয় রাজবংশের সময়ে ২৪৭ থেকে ২৮০ খ্রিঃপূর্বে তৈরি করা হয়েছিল এই লাইটহাউজ , যার উচ্চতা ছিল ১২০ থেকে ১৩৭ মিটার। নির্মাণের পর একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি পৃথিবীর অন্যতম উঁচু দালান হিসাবে চিহ্নিত ছি । এরপরে ১৫৬ থেকে ১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয় ওই এলাকায়। তারই কোনো একটিতে ভেঙে পড়ে ফারো অফ আলেকজান্দ্রিয়া। তবে ১৬ শ শতাব্দীর দিকে ইংল্যান্ডের এডিস্টোন রক্তের উপর নির্মিত লাইট হাউজ ছিল প্রথম খোলা বাতিঘর।
ইংলিশ চ্যানেলের দক্ষিণ পশ্চিমে আটলান্টিকের মাঝে একটি আধডোবা পাহাড় আছে। যেটি এডিস্টোন রক নামেই পরিচিত। এই পাহাড় প্লাইমাউথ বন্দর থেকে প্রায় ১৪ মাইল দূরে অবস্থিত। পাহাড়টির একদম মাঝখানের চূড়াটার নাম এডিস্টোন রক। একটা দীর্ঘ সময় ধরে নৌবহর নিয়ে ওই পথে যাওয়া- আসা করা নাবিকদের আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই আধডোবা পাহাড়টি। এটি ছিল প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি এক চোরাগোপ্তা মৃত্যুফাঁদ।
এমনিতে খুবই সাধারণ দেখতে একটা পাহাড়। বাইরে থেকে এর ভয়ংকর রূপ বোঝা না গেলেও এই সাধারণ চেহারার আড়ালেই লুকিয়ে আছে একটা খুব ভয়ংকর , খুনে চেহারা। সমুদ্রের পানি এই পাহাড়ের কাছে সবসময়ই বিপজ্জনকভাবে পাক খেতে থাকে। জলের চোরা টানে জন্ম নেয় প্রবল ঘূর্ণি। ইংরেজি এডি শব্দের অর্থ ঘূর্ণি। আর সেই কারণেই নাবিকদের মুখে মুখে এই পাহাড়টার নাম হয়ে যায় এডিস্টোন রক বা ঘূর্ণির পাহাড়। সচরাচর ঐ পথে এলে ভয়ংকর পাহাড়টাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত নাবিকেরা। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সম্ভব হত না সেটা। সমুদ্রে জোয়ার এলে ওই পাহাড়ের চূড়া ডুবে যেত জলের মধ্যে। তখন জলের মধ্যে মিশে যাওয়া সেই মগ্ন মৈনাককে চিহ্নিত করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠত। অনভিজ্ঞরা তো আছেই, এমনকি প্রাজ্ঞ নাবিকেরাও তখন পথ ভুলে ধরা দিত সেই খুনে পাহাড়ের খপ্পরে।
যুগ যুগ ধরে এডিস্টোন পাহাড় এভাবেই নাবিকদের কাছে এক বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে রাতের বেলা কোনো জাহাজই ওই পথ দিয়ে যেতে চাইত না। তারপরও পথ ভুলে বা পাহাড়টির চূড়া দেখতে না পেয়ে অনেকসময় জাহাজ এডিস্টোন রকের কাছাকাছি চলে এলেই পড়ে যেত প্রবল ঘূর্ণিতে। জলের প্রবল টানে জাহাজ পাক খেয়ে আছড়ে পড়ত পাহাড়ের পাথরের ওপর। আর সেই ধাক্কায় ভেঙে চুরমার হয়ে যেত জাহাজ, প্রাণে বাঁচত না নাবিকেরাও। কেননা সেই ঘূর্নি থেকে বেঁচে ফেরা অসম্ভব।
এডিস্টোন রকের এই বিভীষিকা থেকে জাহাজ ও নাবিকদের কীভাবে বাঁচানো যায় তার পরিকল্পনা করেন হেনরি উইনস্ট্যানলি। পেশায় ব্যবসায়ী এই মানুষটির নাম লাইটহাউ ইয়ারিং এর পথপ্রদর্শক হিসেবে ইতিহাসে থাকবে চিরকাল। অথচ হেনরি কখনও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করেননি। সফল এই ব্যবসায়ীর একমাত্র ভালো লাগার কাজ ছিল ছবি আঁকা। ব্যবসায়ী হিসেবে খুব অল্প বয়সেই বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি। দেশেবিদেশে বাণিজ্য করার জন্য বেশ কয়েকটি জাহাজও কেনেন।
এর মধ্যে দুটি জাহাজ সমুদ্রে যাবার সময় কোনো কারণে এডিস্টোন পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পড়ায় ঘূর্ণিতে আটকে পড়ে আর পাহাড়ের পাথুরে শরীরে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। উইনস্ট্যানলির ব্যবসায় লোকসান হয় বড়সড়। সেইসঙ্গে ঘটনাটা ভাবিয়ে তুলেছিল তাকে। এই মৃত্যুপাহাড়ের হাত থেকে নাবিকদের কীভাবে রক্ষা করা যায় সেই চিন্তা গ্রাস করতে থাকে হেনরিকে। অনেক চিন্তা করে তিনি ঠিক করেন সেই মরণফাঁদ অর্থাৎ এডিস্টোন পাহাড়ের উপর একটা লাইটহাউস গড়ে তুলবেন যাতে দুর্ঘটনার হাত থেকে জাহাজ ও তাদের নাবিকদের বাঁচানো যায়।
শুরু হয় পরিকল্পনা। সমস্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে ১৬৯৬ সালে শুরু হয় এর নির্মাণ পর্ব। উইনস্ট্যানলি নিজেই লাইটহাউসটির দেখাশোনার ভার তুলে নেন নিজের কাঁধেই। লাইটহাউজ নির্মাণের যাবতীয় নকশাও করলেন তিনি নিজে হাতে। পাশাপাশি নিয়োগ করেছিলেন প্রচুর শ্রমিক। জোয়ার এলে পাহাড়ের যে চূড়াটা পানিতে ডুবে থাকত তার উপর কাঠের কাঠামো বানিয়ে গ্রানাইট পাথরের বারো ফুট ভিত তৈরি করা হয়। সুদূর প্লাইমাউথ বন্দর থেকে জাহাজে করে আনা হয়েছিল এই গ্রানাইট পাথরগুলো।
তিনবছর অক্লান্ত চেষ্টার পর ১৬৯৮ সালে সমুদ্রের মাঝে তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম খোলা লাইটহাউস। এই বাতিঘরটির উচ্চতা ছিল ১২০ ফুট। এর মাথায় কঠিন চর্বির তৈরি মোমের আলো জ্বালিয়ে উদ্বোধন করেন উইনস্ট্যানলি। প্রায় পাঁচবছর স্থায়ী ছিল উইন্সট্যানলির তৈরি এই লাইটহাউস। এই পাঁচবছর বহু জাহাজকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে এডিস্টোন পাহাড়ের বুকে গড়ে ওঠা এই লাইটহাউস।
২৬ শে নভেম্বর , ১৭০৩ সাল। লাইটহাউজে কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেয় এসময়। এমনিতেও উইনস্ট্যানলি তার দল নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে আসতেন লাইটহাউজটি দেখভালের জন্যে। সেদিনও তাই এসেছিলেন। তবে কাজ শেষ হতে অনেকটা রাত হয়ে যাওয়ায় উইনস্ট্যানলি ঠিক করেন তার দলবল নিয়ে সেই রাতটা ওখানেই কাটিয়ে দেবেন। প্রতিদিনের মতো সেদিন রাতেও জ্বলে ওঠে লাইটহাউজের বাতি।
তবে সেদিনের রাতটা ছিল অন্যরকম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে হাওয়ার দাপট। ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল দিয়ে বয়ে আসে প্রলয়ঙ্করী এক ঝড়। সমুদ্রের উথালপাতাল হাওয়া আর বড় বড় ঢেউ ছুটে আসে রাক্ষসের মতো। যেন সবকিছু গ্রাস করতে চায় সে। সমুদ্রের কাছাকাছি বাড়িগুলো খড়কুটোর মতো উড়ে যায় সেই দুর্যোগে। ডুবে যায় ২০০ বেশি জাহাজ। শুধু জাহাজডুবি হয়েই মারা যান আট হাজার যাত্রী ও নাবিক। প্রচন্ড দাপট নিয়ে ঝড় এসে আছড়ে পড়ে এডিস্টোন পাহাড়ের উপর লাইটহাউজের গায়ে। থরথর করে যেন কেঁপে ওঠে সবকিছু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংস হয়ে যায় সব। বিরাট এক ঢেউয়ের আঘাতে দেশলাইয়ের বাক্সের মতো ভেঙে পড়ে লাইটহাউজের বিরাট স্থাপত্য। লোনা জলের তোড়ে কোথায় যে ছিটকে পড়েন উইনস্ট্যানলি আর তার দল। তার হদিস মেলেনি আজো! সেই বিভীষিকাময় রাত্রেই অশান্ত সমুদ্রের বুকে সলিলসমাধি ঘটে উইনস্ট্যানলি সহ পাঁচজনের। যে পথে তিনি আলোর দিশা দিতে এসেছিলেন সেই পথেই হারিয়ে যান চিরতরে। প্রকৃতির কাছে মানুষের শক্তি যে কত সীমিত, আরও একবার প্রমাণ হয় সেই কালরাত্রে।
বর্তমানে এডিস্টোনে যে লাইটহাউজটি আমরা দেখতে পাই তা এডিস্টোন রকের উপর নির্মিত চতুর্থ লাইটহাউজ। প্রথম বাতিঘরের সেই ভয়ংকর পরিণামের পর গড়ে তোলা দ্বিতীয় লাইটহাউজটিও ধ্বংস হয়ে গেছে নির্মাণের কিছু বছর পরই। তৃতীয়টি স্মিটনের টাওয়ার নামে পরিচিত, চারটি লাইটহাউজের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি পরিচিত লাইটহাইজ। এই লাইটহাউজটির উপরের অংশগুলো স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে প্লাইমাউথে স্থাপন করা হয়েছে আবার। চতুর্থ বা শেষ লাইটহাইজটি আজও এডিস্টোন রকের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। অজস্র গল্পে ঘেরা এই লাইটহাউজ বর্তমানে খুলে দেয়া হয়েছে জনসাধারণের দেখার জন্য। যা এখনো স্মৃতি ধরে আছে উইনস্ট্যানলির ত্যাগ।
Post a Comment