Odd বাংলা ডেস্ক: চারদিকে সবুজের সমারোহ। ৭তলা বিশিষ্ট ভবনে প্রায় আট লাখ বর্গফুটের ভবনটিকে লতাপতা আকরে ধরেছে। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি বিদেশি ফল ও ফুলের গাছ। যাতে সূর্যের কিরণ থেকে রক্ষা করে সেখানে ৪টি ওয়াটার বডি”। সেখানে উত্তপ্ত বাতাস এসে শিতল হয়ে তার ভবনের প্রতিটিফ্লোরে প্রবাহিত করে ভবনটিকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দেখে মনে হতে পারে আপনি কোনো এক পার্কে ঘুরতে এসেছেন। যেখানে ইট পাথরের শহরের কালো ধোঁয়া থেকে দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবেন কোনো মূল্য ছাড়াই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন।
সবুজের চাদরে ঢাকা রংপুর নগরীর রবার্টসনগঞ্জ আলমনগরে স্থাপিত কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের এই কারখানা। কারখানাটির প্রতিটি ফ্লোর ৪০ হাজার বর্গফুটের। সেখানে দিনে ও রাতে কাজ করে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। যার প্রায় ৯০ শতাংশই নারী। শ্রমিকেরা যেসব ফ্লোরে কাজ করেন সেখানে নেই কোনো ফ্যান বা এসির ব্যবস্থা। এই গ্রীষ্মের তাপদাহ শ্রমিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের শরীর ছুতে পারে নি। অস্বস্তিকর গরমের দিনেও কোনো শ্রমিকের শরীরে ঘাম ঝড়ে না। কারখানার বাহিরের তাপমাত্রা যত ডিগ্রী থাকুকনা কেন কারখানার ভেতরে সবসময় শীতল ভাব অনুভুত হবেই। কারখানার ভবন শীতল রাখা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের স্থাপত্যকৌশল প্রয়োগ করে।
এতে করে কারখানাটির বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে বলে জানান সেখানকার জেনারেল ম্যানেজার সিদ্ধার্থ লাহিড়ী। তিনি জানান, বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনে আমরা একটি সবুজ ও তাপমাত্রা সহনশীল কারখানা গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। কারখানার গণসংযোগ বিভাগের উপদেষ্টা মাহবুব রহমান হাবু জানান, কারখানার শ্রমিকদের কাজ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট হয়। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের। তাদের মাথার ওপর যতই ফ্যান ঘুরুক না কেন, গরমের ভাব কাটে না। তাই ভবনকে শীতল রাখার জন্য আমরা বিভিন্ন প্রজাতির ফল ও ফুলের গাছ এখানে রোপন করেছি। দেশের এক ধরনের লতা জাতীয় উদ্ভিদ ৭ তলা ভবনের চারিদিকে রোপন করেছি। লাতাগুলো বড় হয়ে ভবন টিকে আকরে ধরে সূর্যের কিরণ থেকে রক্ষা করেছে। শ্রমিকেরা এখানে বাড়ির চেয়েও বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
তিনি জানান, ৩ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠা এই কারখানাটিকে শীতল রাখতে সেখানে দক্ষিণ মুখি ৪টি ওয়াটার বড়ি তৈরী করা হয়েছে। এমন ভাবে কারখানার স্থাপত্য নকশায় তৈরি করা হয়েছে, যাতে কারখানার ভেতরে বাতাস প্রবাহিত হয়। নিচতলায় যে চারটি ওয়াটার বডি নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে পানির রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ লিটার। আয়রনমুক্ত এই পানি কারখানায় শতরঞ্জি ডাইংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। আবার এই পানি উত্ত্ধসঢ়;প্ত বাতাস শীতলী করনের কাজেও আসে।
সবুজ গাছপালা আর এই পানির ওপর দিয়ে উড়ে আসা বাতাস ৭ তলা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে যায়। ফলে এসি বা ফ্যান ছাড়াই কারখানার বাইরের চেয়ে ভেতরের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। দক্ষিণা বাতাস কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে পুরো ভবনটিকে শীতল রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
কারখানার কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত ভবনের মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ১০ ফুট হয়। কিন্তু এখানকার প্রতিটি তলার মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা রয়েছে ১২ ফুট। এতে গরম কিছুটা কম অনুভব হয়। এ ছাড়া কারখানার প্রতি তলায় মেঝের মধ্যে যন্ত্র চালানোর ফলে গরম বাতাস বের হয়, সেই বাতাসও যেন ঘরের ভেতর ঘুরপাক না খায় এ জন্য মেঝের মধ্যে প্রতিটি যন্ত্রের নিচে ফুটো রয়েছে। মেঝের মধ্যে এসব ফুটো দিয়ে গরম বাতাস বের হয়ে যায়।
আমাদের দেশে বছরের বেশিরভাগ সময় গরমের দাপট থাকে। তবে রংপুরের আবহাওয়া ৪ মাস সহনশীল অবস্থায় থাকে। আর শীতকালে দক্ষিণের বাতাস তেমন একটা থাকে না। ওই সময় প্রবাহিত হয় উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাস। এ সময় শীত যেন বেশি অনুভূত না হয়, এ জন্য কারখানার উত্তরে জানালা বন্ধ রাখা হয়। গ্রামাঞ্চলে ভিটেবাড়ির দক্ষিণ দিকটি খোলা রাখা হয় এবং সেদিকে একটি পুকুর থাকে। গরমকালে পুকুরের ওপর দিয়ে বাতাস শীতল হয়ে এসে বাড়িতে প্রবেশ করে বেরিয়ে যায়।
প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী গরম বাতাস ওপরে ওঠে। আর শীতল বাতাস নিচে পড়ে থাকে। এই গরম বাতাস ছাদের ওপর চিমনির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে পুরো ভবন শীতল হয়ে আসে। কারও জ্বর হলে যেমন কপালে জলপট্টি দেয়া হয়, কারখানাটিতেও সে রকম জলপট্টি দেয়া হয়েছে বলা চলে। কথা হয় কারখানার অনেক শ্রমিকের সঙ্গে। নগরীর শালবন এলাকার শ্রমিক আকলিমা খাতুন জানান, বাড়ি থেকে বের হয়ে কারখানায় প্রবেশ করার পর মনটা ভরে যায় এখানকার পরিবেশ দেখে। এখানে কাজ করতে কোনো কষ্ট হয় না। না শীত না গরম তা বোঝা যায়না। পরিবেশও ভালো।
এই কারখানার শ্রমিক নুরবানু জানান, তার বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের বিরাহীম এলাকায়। প্রতিদিন বাবার কিনে দেয়া বাইসাইকেল নিয়ে কারখানায় আসেন। সাইকেলে করে কারখানায় আসার সময় ঘামে শরীর ভিজে যায়। কাজে যোগ দেয়ার পর শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। লাগেনা ফ্যানের বাতাস কিংবা এসির বাতাস। তিনি জানান কারখানার পরিবেশ এমন হওয়া দরকার। যাতে করে শ্রমিকেরা মন ভরে কাজ করতে পারে।
কারখানার প্রথম তলা ভবনের ছাদেও সবুজের বাগান। এটার নাম দেয়া হয়েছে ‘নন্দিনী পার্ক’। ছাদের মধ্যে গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য ছোট ছোট অনেক বেঞ্চ আছে। পানির ফোয়ারা আছে। আছে পদ্মফুল। এখানেই দুপুরের খাবার খান শ্রমিকেরা। এছাড়াও ৫ আসনের একটি ডাইনিং আছে সেখানে।
কারখানার জেনারেল ম্যানেজার সিদ্ধার্থ লাহিড়ী জানান, কারখানার অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা অত্যাধুনিক। কোন স্থান থেকে ধোয়া বের হলে অটোমেটিক ফায়ার এলার্ট চালু হয়ে যাবে। এই কারখানার শতকরা ২০ ভাগ শ্রমিকের ফায়ারের ট্রেনিং আছে। এখানে ১ শত মিটার পর পর হোসপাইম আছে।
এছাড়াও প্রতিটি তলায় সুরক্ষারও ব্যবস্থা আছে। তিনি জানান, এখানকার বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাও অত্যাধুনিক। এখানে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তাতে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিটের কোনো ভয় নাই। আর শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগারও সুযোগ নেই। কারখানার গণসংযোগ বিভাগের উপদেষ্টা মাহবুব রহমান হাবু জানান, বিনা মূল্যে কারখানার শ্রমিকদের দুপুর ও রাতে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এখানকার শ্রমিকেরা যা খাবে মালিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা একই খাবার খাবে। এখানে মালিক থেকে শুরু করে সকলেই একসঙ্গে মিলে খাবার খায়। কে মালিক, কে শ্রমিক, কে কর্মকর্তা আর কে কর্মচারী এখানে তার কোনো ভেদাভেদ নাই। এখানে যারা কাজ করে তারা সকলেই একই সূতায় বাধাঁ। এখানে সকলের অধিকার সমান।
তিনি বলেন, এখানে ৪ বেডের একটি হাসপাতাল রয়েছে। শ্রমিকদের দেখভাল করার জন্য ২ জন চিকিৎসক, নার্স ও সহকারী রয়েছে। তাদের বিনামূল্যে ঔষধসহ সবকিছু ফ্রি দেয়া হয়। বড় ধরনের কোনো শারীরিক সমস্যা হলে আমরা তাৎক্ষনিক তাকে হাসপাতালে প্রেরণ করি। এখানে রয়েছে ডে কেয়ার সেন্টার। রয়েছে শিশুদের নানা রকম খেলনা সামগ্রীর ব্যবস্থা। শ্রমিকদের বিনোদনের জন্য গড়েতোলা হয়েছে রোকেয়া মঞ্চ। বিভিন্ন দিবসে এখানকার শ্রমিকেরা নিজেরাই সাংস্কৃতি অনুষ্টান করে থাকে।
কারখানার গণসংযোগ বিভাগের উপদেষ্টা জানান, শ্রমিকরা বাজার মূল্যের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ ভাগ কম দামে তাদের নিত্যপণ্য সামগ্রী কিনতে পারে সে জন্য সেখানে একটি মুদি দোকানও রয়েছে। সেখান থেকে শ্রমিকেরা কেনাকাটা করে মাস শেষে তা পরিশোধ করতে পারেন। সেখানে একটি বেসরকারী ব্যাংকের এটিএম বুথ রয়েছে। সেই বুথ থেকে এটিএম কার্ডের সাহায্যে মাসের বেতন তুলতে পারেন।
Post a Comment