চোখ থাকতেও অন্ধ এই গ্রামের বাসিন্দারা
Odd বাংলা ডেস্ক: আমরা চোখ দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখি। এছাড়া এর মাধ্যমে জীব, প্রজাতি, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে থাকি। অর্থাৎ সামনের যে কোনো কিছু দেখার কাজই করে চোখ।
চোখের কাজ কী? চোখ, মূলত প্রাণীর আলোক-সংবেদনশীল অঙ্গ ও দর্শনেন্দ্রীয়। প্রাণিজগতের সবচেয়ে সরল চোখ কেবল আলোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির পার্থক্য করতে পারে। উন্নত প্রাণীদের অপেক্ষাকৃত জটিল গঠনের চোখগুলো দিয়ে আকৃতি ও বর্ণ পৃথক করা যায়। অনেক প্রাণীর (এদের মধ্যে মানুষ অন্যতম) দুই চোখ একই তলে অবস্থিত এবং একটি মাত্র ত্রিমাত্রিক দৃশ্য গঠন করে। আবার অনেক প্রাণীর দুই চোখ দুইটি ভিন্ন তলে অবস্থিত ও দুইটি পৃথক দৃশ্য তৈরি করে (যেমন- খরগোশের চোখ)।
যাদের দৃষ্টিশক্তি আছে তারা তো এই চোখ দিয়ে দেখে; তবে কখনো কী ভেবেছেন যাদের দৃষ্টিশক্তি নেই তারা কীভাবে কাটায়? তারা না দেখতে পারে পৃথিবীর আলো, না দেখতে পারে কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে আবার যদি এমন হয়, এক সময় আপনি সবই দেখতে পেতেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে আপনি আর কিছুই দেখতে পান না তাহলে কেমন হবে ভাবুন?
পাঠক নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কী বলতে চাইছি? প্যারান, পেরুর একটি গ্রাম। খুব ছোট একটি গ্রাম এটি। সবুজ শ্যামল প্রকৃতিঘেরা সুশীতল গ্রামটি সবার নজরে পড়ে। জানা গেছে, পাহাড়ি এই গ্রামটিতে মাত্র সাড়ে তিনশ’ লোকের বসবাস। গ্রামবাসীরা একটা পরিবারের মতো সবাই মিলেমিশে বসবাস করেন। সেখানে নেই কোনো ঝুট-ঝামেলা, নেই কোনো মারামারির খবর। ভাই-বোনদের মতো এর প্রতিবেশীরাও মিলে মিশে থাকে।
তবে দুঃখের বিষয় হলো- এই গ্রামের পুরুষদের বেশীরভাগ একটি জটিল রোগে ভুগেন। প্রায় সবারই বয়স ৫০ হওয়ার আগেই দৃষ্টিশক্তি হারান তারা। পরে ধীরে ধীরে স্থায়ী অন্ধত্বের দিকে ঝুঁকে যান পুরুষরা। এ কারণে প্যারান গ্রামটিকে ‘অন্ধদের গ্রাম’ বা ‘দৃষ্টিহীনদের গ্রাম’ বলে ডাকে পেরুর লোকজন।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এমনটা হয় তাদের? এর কোনো সঠিক কারণ বিশেষজ্ঞরা ঠিকভাবে দিতে না পারলেও অনেকে মনে করছেন এটি একটি ‘রাতকানা’ রোগ। তবে আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যমের সূত্রে বলা হয়েছে, প্রায় তিন হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই চোখের একটি জিনগত রোগে আক্রান্ত। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে একে ‘রাতকানা’ বললেও রোগটি পুরোপুরি রাতকানা না। কারণ রাতকানা রোগে অপেক্ষাকৃত স্বল্প আলোয় দেখা কঠিন বা প্রায় অসম্ভব। এটা আসলে কতিপয় চোখের রোগের উপসর্গ। কারো ক্ষেত্রে জন্ম থেকে এই সমস্যা থাকে, এছাড়া চোখে আঘাত বা অপুষ্টির কারণে (যেমন ভিটামিন এ এর অভাব) এই সমস্যা হতে পারে। রাতকানা রোগে স্বল্প আলো বা অন্ধকারে চোখের অভিযোজন ক্ষমতা হ্রাস পায় বা নষ্ট হয়ে যায়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাতকানা রোগীরা শুধু রাতের বেলা দেখতে সমস্যা হয়। তবে এই গ্রামের বাসিন্দারা আগে দেখলেও পঞ্চাশের পর আর দেখতে পান না।
পেরুর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘রাতকানা’র জন্য প্রধানত দায়ী এই রোগটি। এর ফলে রেটিনার রড কোষ ধীরে ধীরে আলোর প্রতি সাড়া দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এটা এক ধরনের জেনেটিক রোগ যেখানে রাত্রিকালীন দৃষ্টির পাশাপাশি দিনের বেলা দেখার ক্ষমতাও নষ্ট হতে থাকে। রাত্রিকালীন অন্ধত্বের ফলে জন্ম থেকে রড কোষ জন্মের পর থেকেই কাজ করে না, বা অল্প পরিমাণ কাজ করে। কিন্তু এই অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা দৃষ্টিশক্তি হারায়।
এছাড়াও চোখের ভেতরে রেটিনা নামের যে গুরুত্বপূর্ণ পাতলা মেমব্রেন থাকে, তার প্রধান দুটি অংশ হলো রড ও কোণ। এই রড আর কোণ ‘ফটো রিসেপ্টর’র কাজ করে। এই রোগের ফলে রেটিনার রড কোষ ধীরে ধীরে তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে মানুষ অন্ধত্বের শিকার হয়। আর পেরুর ‘প্যারান’ গ্রামের বেশিরভাগ লোক ‘রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা’য় আক্রান্ত। এই রোগের কারণে এ গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে কারো শৈশব থেকেই দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, কারো আবার বয়স পঞ্চাশ পেরুতে না পেরুতেই চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে।
এদিকে, কয়েক বছর আগে নাকি ওই গ্রামটিতে একদল চক্ষু চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানিয়ে দেন, পুরুষদের চোখের এই রোগ আসলে জীনগত। এক্স ক্রোমোজোমের সমস্যা থেকেই এর সৃষ্টি হয়।
ওই সময় চিকিৎসকরা আরো জানান, নারীদের চেয়ে ‘রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা’-এ পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হন। পরপর বেশ কয়েকজন রোগীকে নিয়ে গবেষণা করে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই গ্রামে ছেলেসন্তান জন্মালে তার অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই বেশি।
এই কারণে এখন অনেকেই ওই গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ান না। তাই সভ্যতার আলো পৌঁছালেও, পেরুর এই গ্রামটি আজও দেশের অন্যান্য জনপদ থেকে বিচ্ছিন্নই রয়ে গেছে। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হারালেও প্রকৃত সুখে আছেন তারা, কারণ চোখে না দেখলেও তারা কখনো বিবাদে জড়ান না।
Post a Comment