কুলীন ব্রাহ্মণের মেয়ে থেকে সোনাগাছির যৌনকর্মী! ৭ 'খুন' করে হয়ে উঠলেন বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার
উজ্জ্বল মন্ডল: সময়টা ১৮৫৭-এর কিছু পরের। বর্ধমানের এক গ্রামে কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে বেড়ে উঠছে একটি মেয়ে। তাই নিয়েই ঘোর চিন্তায় মেয়ের বাপ-মা। ৭-৮ বছরের মেয়েকে যে বিয়ে দিতেই হবে এবার। নাহলে জাত যাবে। আবার যা তা ঘরে তো বিয়ে দেওয়া যায় না। ছেলেকেও কুলীন ব্রাহ্মণ হওয়া চাই। এভাবেই সুপাত্রের খোঁজে কেটে গেল কয়েক বছর। অবশেষে বিয়ের সাধ মিটল ত্রৈলোক্যতারিণীর। পঞ্চাশোর্ধ্ব এক প্রৌঢের সঙ্গে বিয়ে হল তাঁর। স্বামী সোহাগের সাধ তো মিটলই না। উল্টে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বিধবা হতে হল তাঁকে।
এবার প্রশ্ন, অজ পাড়া-গাঁয়ের ত্রৈলোক্যতারিণী কিভাবে জড়িয়ে পড়লেন অপরাধ জগতে? কিভাবে তিনি হয়ে উঠলেন সিরিয়াল কিলার? এই উত্তরের শুরু বর্ধমানে। শেষ শহর কলকাতায়। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
ত্রৈলোক্যের স্বামীর মৃত্যুর পর 'তারা বৈষ্ণবী'র সঙ্গে গভীর সখ্যতা তৈরি হয় তাঁর। তারার মারফতই এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। যে চাহিদা তাঁর স্বামী পূরণ করতে পারেননি, ত্রৈলোক্যের সেইসব চাহিদা পূরণ করে দিলেন গৌর নামের ওই যুবক। সেকেলে সমাজে বিধবার এমন সম্পর্ক যে মেনে নেবে না। তাই লুকিয়েই চলত এই প্রেম ভালবাসা। তবে বেশিদিন এই সম্পর্ক চাপা থাকেনি। একদিন এক কুটিরে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় পাওয়া যায় তাদের। গ্রামে ত্রৈলোক্যের নামে নিন্দার ঝড় ওড়ে। গরীব বাবা-মাও এই অপরাধের জন্য বিষ খাইয়ে মেরে দিতে চায় মেয়েকে। এই অবস্থায় প্রেমিক গৌরের সঙ্গে পালিয়ে যায় ত্রৈলোক্য। সংসার বাধার স্বপ্ন নিয়ে।
কিন্তু ঘটে ঠিক তার বিপরীত। ওই যুবক ত্রৈলোক্যকে বিক্রি করে দেন সোনাগাছিতে (তৎকালীন সোনাগাজি)। সংসার গড়ার স্বপ্ন ভেঙে যায় ত্রৈলোক্যর। শুরু হয় অন্য জীবন। নাম, বেশ্যাবৃত্তি। এই পেশাতে কিছুদিনের মধ্যে সাফল্য অর্জন করেন তিনি। সোনা-গয়না, টাকা, বাড়ি সবই হয় তাঁর। খদ্দেরদের ঢলও নামে। কিন্তু পরিবর্তন ঘটে তাঁর জীবনে কালী নামক এক দালালের আগমনের পর।
কালীবাবুর প্রেমে পাগল হয়ে তাঁর ব্যবসা থেকে মন সরে যায়। খদ্দের কমতে থাকে। এদিকে ওই ব্যক্তিও দালালি বন্ধ করে ত্রৈলোক্যের টাকায় ফুর্তি করে বেড়ায়। একসময় সংসারে টান পড়তে শুরু করে। তখন থেকেই অপরাধ জগতকে আপন করে নেন ত্রৈলোক্য!
প্রথমে কমবয়সী যুবকদের ঘরে এনে তাদের অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুঠ করা। তারপর দুজনে মিলে বেশ্যাদের ব্রাহ্মণদের মেয়ে সাজিয়ে টাকা-গয়না নিয়ে ভুয়ো বিয়ে দেওয়ার মত, একাধিক লোক ঠকানো কাজ করেন। এমনকি কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নাবালিকাদের চুরি করেও এই ব্যবসা চালাতেন তাঁরা।
কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, ত্রৈলোক্যতারিণী কিভাবে সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠলেন? এর নেপথ্যে রয়েছে পুলিশ এবং সংসারে অনটন। আসলে শহর থেকে শিশু চুরির ঘটনায় অপরাধীদের খোঁজে তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ। বিশেষ করে সোনাগাছিতে তো পুলিশের অভিযান চলতেই থাকে। তখনই সচেতন হয়ে যান তাঁরা। এ ব্যবসা ছেড়ে দেন। ঠিক করেন, অন্যকিছু। যে অপরাধ ছিল আরও মারাত্মক, আরও ভয়ঙ্কর।
প্রথমে তাঁরা টার্গেট করে বড়বাজারের এক নামজাদা স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে। রাজা চক্রধর সিংয়ের ম্যানেজার ছদ্মবেশে কালীবাবু ওই ব্যবসায়ীর দোকান থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা হাতিয়ে নেন। টাকা নিয়ে আসেননি এমন ভান করে, তাঁর সঙ্গে কাউকে পাঠাতে বলেন। দোকান মালিক এক কর্মচারীকে পাঠালে, তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেন ত্রৈলোক্য এবং কালীবাবু। তবে এ ঘটনা বেশিদিন চাপা থাকেনি। জাঁদরেল দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের হাতে ধরা পড়েন কালী। খুনের অভিযোগে ফাঁসি হয় তাঁর। তবে ত্রৈলোক্য স্বপক্ষে তেমন প্রমাণ না থাকায় সেবারের মত ছাড়া পেয়ে যান তিনি।
এরপর বেশ কিছুদিন অপরাধ জগতের বাইরে থাকলেও, কিছুতেই সেই জগৎ থেকে পুরোপুরি সরে আসতে পারেননি। পুত্রসম হরির টাকার জন্য অত্যাচার, তাঁকে আরও অর্থ উপাজর্নের দিকে ঠেলে দেয়। তাঁর জন্য আরও খুন করতে উদ্যত হন তিনি।
একটা নয়, পরপর পাঁচটি খুন করেন তিনি। প্রথম শিকার, তাঁর সোনাগাছির এক বান্ধবী। যাকে সোনা ডবল হওয়ার লোভ দেখিয়ে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন মানিকতলা ছাড়িয়ে এক ঘন জঙ্গলে। সাধুবাবার সঙ্গে দেখা করাবার আশা দেখিয়ে, জলের মধ্যে শ্বাসরোধ করে মেরেছিলেন তাঁকে। তারপর হাতিয়ে নিয়েছিলেন সব সোনা।
এই একই স্টাইলে তারপর আরও চারটি খুন করেন তিনি। সবকটি লাশ ভাসতে দেখা যায় জঙ্গলের মাঝে এক পুকুরে। তবে ছ'নম্বর খুনটা করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান তিনি। স্থানীয়রা তাঁকে ধরে পুলিশের কাছেও নিয়ে যায়। তবে সেসময় আইনের কিছু ফাঁকফোকড় থাকায় বেঁচে যান ত্রৈলোক্য।
অবশেষে সাল ১৮৮৪। পাঁচু ধোপানির গলির একটি বাড়িতে রাজকুমারী দাসীর হত্যাকাণ্ডে শেষ হয়ে যায় ত্রৈলোক্যের জীবন। সেবছর ৯ অগাস্ট সেই সোনার লোভেই রাজকুমারীকে খুন করেন ত্রৈলোক্য। জানিয়ে রাখি, এই বাড়িতেই ঘটনার কিছুদিন আগে ভাড়ায় আসেন ত্রৈলোক্য ও হরি। রাজকুমারীকেও শ্বাসরোধ করে খুন করেন তিনি। কিন্তু পুলিশ প্রথমে ঠাওরই করতে পারছিলেন না খুনি কে! কারণ ত্রৈলোক্যই নাকি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছিল এই খুনের মামলায়। আসলে সবটাই ছিল তাঁর চালাকি।
অবশেষে এই খুনিকেই ফাঁদে ফেললেন সেই দারোগা প্রিয়নাথ। ছেলে হরিকে বলির পাঁঠা করে ত্রৈলোক্যকে গ্রেফতার করল পুলিশ। জানা যায়, ত্রৈলোক্যর মত নৃশংস অপরাধীকে দেখতে নাকি সেসময় ভিড় উপচে পড়ত। অবশেষে ১৮৮৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ত্রৈলোক্যতারিণী রাঁড় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়।
জানা যায়, ফাঁসির আগে দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে দুটি প্রার্থনা করেছিলেন তারিণী। এক, ত্রৈলোক্যর হয়ে বিদ্যাসাগরকে প্রণাম করার কথা বলেছিলেন দারোগাবাবুকে। আর দুই,, নিজের ছেলেকে মাঝেমধ্যে দেখার জন্য দরোগাবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি।
ফাঁসির মাধ্যমে শেষ হয় তাঁর অপরাধের অধ্যায়। তবে তৈরি হয় ইতিহাস। কারণ কলকাতা পুলিশের নথিতে সে-ই সম্ভবত প্রথম সিরিয়াল কিলার।
তথ্যসূত্র: দারোগার দপ্তর- প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যয়
বাবু ও বারবনিতা- দেবারতি মুখোপাধ্যায়
Post a Comment