Odd বাংলা ডেস্ক: মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকালে সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯৩৯ সালে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা। কোটি কোটি মানুষ মারা গিয়েছে। সর্বোস্ব হারিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে হতভম্ব করেছিল। হিটলারের নাৎসি বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে পুরো বিশ্বে।
বিশ্বের অন্যতম খারাপ এবং বিতর্কিত মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম তিনি। নারকীয় হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার, প্রেম, আত্মহত্যা সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার নেশায় আসক্তির খবর। এমনকি ইতিহাসবিদদের দাবি, নেশা দ্রব্য না পেয়েই আত্মহত্যা করেছিলেন হিটলার। হিটলারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. থিওডোর মোরেলের লেখা ‘দ্য টোটাল রাশ’ বইতেও পাওয়া যায় এই মাদকের উল্লেখ।
সময়টা ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। জার্মানির নাৎসি বাহিনী পোল্যান্ড অধিগ্রহণ করার ঠিক পর পরই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ফ্রান্স। তবে হিটলারের বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠেনি ফ্রান্স। অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই ধীরে ধীরে পিছু হঠতে শুরু করল ফ্রান্সের ফ্রন্টলাইন। আর তারপরই ঘাতক জার্মান আক্রমণ। আর্দেনস পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সের মধ্যে ঢুকে পড়ল জার্মান সেনারা। ১৯৪০ সালের ২৫ জুন মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নেয় জার্মানি। ফ্রান্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তো বটেই, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডেরও বেশ কিছু অংশের দখলদারি নিলেন হিটলার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে জার্মানির সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর, সেটাই হিটলার করে দেখালেন মাত্র ৬ মাসের মধ্যে। প্রতিপক্ষের কাছেও এই বিষয়টি ছিল আদ্যন্ত রহস্যময়। সত্যিই কি শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকার কারণেই এহেন সাফল্য ছিল জার্মানির?
আসলে এই জয়ের কারণ শুধু উন্নত অস্ত্র এবং যুদ্ধের ট্যাকটিক্স নয়। হিটলার ভালোই বুঝেছিলেন যুদ্ধজয়ের প্রথম শর্তই হল সেনানীদের কর্মক্ষমতা। তারা যন্ত্রণা, কষ্ট ও প্রাকৃতিক চরমাবস্থা সহ্য করে একটানা লড়াই করে গেলে সহজেই জয় আসবে হাতে। আর সেই জায়গাটাতেই দৃঢ় করেছিলেন হিটলার। সৈন্যদের চাঙ্গা রাখতে ব্যবহার শুরু করেছিলেন ‘ম্যাজিক পিল’-এর। কিন্তু কী এই ‘ম্যাজিক পিল’?
ল্যাবরেটরিত তৈরি এক ধরনের সিন্থেটিক স্ফটিক এই ওষুধ। এই সিন্থেটিক ড্রাগ মূলত সজাগ করে রাখে মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে। ক্লান্তি, ঘুম, ক্ষুধার মতো অনুভূতিগুলোকে কমিয়ে বাড়িয়ে দেয় দেহের অ্যাড্রিনালিন হরমোনের ক্ষরণ। ফলে সার্বিকভাবে বৃদ্ধি পায় কর্মক্ষমতা। নাৎসি বাহিনীর প্রতাপের পিছনেও দায়ী ছিল এই ওষুধটি। বিশ্বযুদ্ধের বেশ কিছু নথিতেই স্পষ্ট উল্লেখিত রয়েছে, ফ্রান্স অধিগ্রহণের সময় জার্মান সেনারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন একটানা প্রায় তিন দিন। এক প্রতিবেদনে ইতিহাসবিদরা দাবি করেন, যুদ্ধের সময়টাতে প্রায় ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি ‘ম্যাজিক পিল’এসেছিল সৈন্যদের কাছে।
সিন্থেটিক ড্রাগের শুধু আবিষ্কার ছিল জার্মানরাই। এমনকি ব্যবহারও শুরু হয়েছিল তাদের হাত ধরেই। ১৯৩৮ সালে তখন প্রাক্-বিশ্বযুদ্ধের জার্মানি। হিটলারের সম্মতিতেই বার্লিনে গড়ে উঠল টেমলার ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা। আর সেই কারখানাতেই শুরু হল মেথের গণউৎপাদন। ‘পারভিটিন’ নামে ট্যাবলেটের আকারে বাজারে এল সেই ড্রাগ। উদ্দীপক এবং হতাশানাশক ওষুধ হিসাবেই তা পাওয়া যেত জার্মানির সমস্ত কাউন্টারে। অবশ্য তার আগে ৯০ জন ইহুদি শিক্ষার্থীদের ওপরে এই ওষুধের ‘ট্রায়াল’ চালিয়েছিলেন এক নাৎসি মিটিটারি চিকিৎসক।
নথি অনুযায়ী, ১৯৪০ সালে ফ্রান্স অধিগ্রহণের সময় প্রায় সাড়ে তিন কোটি ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছিল জার্মান সেনাদের। তবে সব সেনারাই যে এক ধরনেরই ড্রাগ ব্যবহার করতেন, তেমনটা নয়। তাদের ছিল নিজস্ব পছন্দের বিশেষ ওষুধ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা। কোনো ওষুধ তাদের যন্ত্রণামুক্ত করত, আবার কোনো কোনো ড্রাগ ব্যবহৃত হত গতিবৃদ্ধির জন্য। উদাহরণ হিসেবে জার্মান লেখক ও গবেষক ওহলার তার ‘ব্লিৎজড’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, জার্মান বিমান প্রযুক্তিবিদ আর্নেস্ট উডেত ব্যবহার করতেন মেথ। আবার গোরিং-এর মতো সেনাপ্রধান নিতেন অ্যানাস্থেটিক। এমনকি ‘গোরিং’ নামটিরও উৎপত্তি ‘মোরিং’ থেকে। যা কিনা মরফিনের জার্মান প্রতিশব্দ।
আর হিটলার? হিটলার নিজেও অভ্যস্ত ছিলেন এই মাদকসেবনে। শুধু মাদকই নয়, বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনও নিতে ফুয়েরার। এবং তা বিশ্বযুদ্ধেরও বহু আগে থেকে। এখানে জার্মান চিকিৎসক ড. থিওডোর মোরেলের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। তিরিশের দশকের একেবারে শুরুর দিকে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হিটলারের। হিটলার তখন ভুগছেন অন্ত্রের সমস্যায়। ব্যাকটেরিয়াজাত একটি ওষুধের মাধ্যমে হিটলারকে সারিয়ে তুলেছিলেন মোরেল। তারপরই তার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে ওঠেন ফুয়েরার। মিউনিখের ‘ইনস্টিটিউট অফ কন্টেম্পোরারি হিস্ট্রি’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল আর্কাইভ’-এ এখনও সংরক্ষিত রয়েছে মোরেলের লেখা ডায়েরি। সেই নথি থেকেই জানতে পারা যায় হিটলার প্রায় প্রতিদিনই অ্যামফিটামিনস, বারবিট্রেটস, আফিয়েটস, মেথ-সহ একাধিক ড্রাগ নিতেন। যদিও পারভিটিন ব্যবহার করতেন না তিনি।
সেসময় জার্মানিতে ‘হিটলারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক’ হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন ড.মোরেল। হিটলারের তত্ত্বাবধানেই তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন হরমোন নিয়ন্ত্রক ও কৃত্রিম ভিটামিনের ব্যবহারের ওপর। সেসব ওষুধের ট্রায়াল চলত বন্দি ও ইহুদিদের ওপরে। ট্রায়াল সফল হলে, তা প্রথম প্রয়োগ করা হত ফুয়েরারকেই। সব মিলিয়ে শেষ ৯ বছরে প্রায় ৮০০ রকমের ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন হিটলার।
তবে যুদ্ধে ব্যাপকভাবে এই ড্রাগের ব্যবহার জার্মানিকে বাড়তি শক্তিপ্রদান করলেও, এই ড্রাগই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিটলারের। ওহলারের গবেষণা বলছে, ১৯৩০ সালের পর থেকেই হিটলারের মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। তার ছাপ স্পষ্ট হিটলারের আত্মজীবনে ‘মেইন ক্যাম্প’-এ। শুধু তাই নয়, ড্রাগ সেবনের কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বৈদেশিক সম্মেলনে বার বার উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন হিটলার। ড্রাগের প্রভাবেই নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। যে কারণে, ‘বন্ধু’ স্তালিনও শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছিল তার প্রতিপক্ষ।
আর হিটলারের মৃত্যু? গল্পটা তো সকলেরই জানা। ১৯৪৫ সালে বার্লিনের বাঙ্কারে নিজের মাথায় গুলি করে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেছিলেন ফুয়েরার। কিন্তু এর পিছনেও রয়েছে ড্রাগের প্রভাব, এমনটাই অনুমান ওহলারের। বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষে যখন জার্মানির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল মিত্রশক্তি, তখন বন্ধ হয়ে যায় সিন্থেটিক ড্রাগের উৎপাদন। বাঙ্কারে গা ঢাকা দিয়ে থাকে হিটলারের অবস্থা তখন হয়ে উঠেছিল পাগলপ্রায়। শেষ পর্যন্ত কি সেই কারণেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আত্মহত্যার? জানা নেই উত্তর। তবে ওহলারের এই অনুমান যে ১০০ শতাংশ ভুল, তারও প্রমাণ দিতে পারেনি কেউ। ইতিহাসবিদরাও ধারণা করেন ড্রাগের নেশা চরমে ছিল হিটলারের। আর মাদকাসক্ত হওয়ার কারণেই আত্মহত্যা করাটা সহজ হয়েছিল তার জন্য। কেননা জীবনের মায়া ভুলে গিয়েছিলেন হিটলার বহু আগেই।
Post a Comment