Odd বাংলা ডেস্ক: প্রবাদে রয়েছে ‘কিসের বার কিসের তিথি, আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী।’ এদিন থেকেই হয় অম্বুবাচী শুরু। জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করেন, তার পরবর্তী সেই বারের সেই কালে অম্বুবাচী হয়। অর্থাৎ, পৃথিবী এই সময়ে ঋতুমতী হন।
অম্বুবাচী হিন্দুধর্মের বাৎসরিক উৎসব। লোকবিশ্বাস মতে আষাড় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। এই সময়টিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়।
হিন্দু শাস্ত্রে ধরিত্রীকে মা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জননী মাতা, দেশ মাতা, ধরিত্রী মাতা।অম্বুবাচীর তিন দিন পর্যন্ত কোনো ধরনের মাংগলিক কার্য করা যায়না। চতুর্থ দিন থেকে মঙ্গলিক কাজে কোনো বাধা থাকেনা। অম্বুবাচীর সময় হাল ধরা, গৃহ প্রবেশ, বিবাহ ইত্যাদি শুভ কাজ করা নিষিদ্ধ থাকে ও এই সময়ে মঠ-মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকে।
ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখতে গেলে এই অম্বুবাচীর সঙ্গে কৃষিকাজের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভাবে জড়িত রয়েছে । গ্রীষ্মের প্রখর তাপ প্রবাহের পর শুষ্ক ধরিত্রী কে বর্ষার জলসিঞ্চন এর মাধ্যমে উর্বর করার জন্য কিছুদিন বিশ্রাম প্রদান করা হয়। মৃত্তিকা হয়ে ওঠে উর্বর । উর্বর মৃত্তিকাই প্রদান করতে পারে উৎকৃষ্ট মানের ফসলের। শুধু ঐতিহাসিক নয় তান্ত্রিক মতে ও এই ধারনাই মান্যতা পায়।
শস্য শ্যামল উর্বর পৃথিবীর জন্য সন্তানগণ ধরণী মায়ের নিকট এই তিনদিন প্রার্থনা করেন। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার বুক থেকে উৎপন্ন শস্য খাদ্য হিসাবের গ্রহণ করে দুধে ভাতে বেচে থাকতে পারে।
পৃথিবীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার জন্য 1970 সাল থেকে 22 এপ্রিল প্রতিবছর 193 টি দেশ world earth day পালন করে থাকে । কিন্তু এই বিশ্ব মাতৃকার প্রতি ,ধরণী মাতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও তাকে রক্ষার সংকল্প হিন্দু জাতি সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই করে আসছেন এই অম্বুবাচী পালনের মাধ্যম দিয়ে।
শুধু ধরণী কেন এই ধরণীর বুকে বসবাসকারী গাছপালা পশু পাখি ফুল ফল জল প্রতিটি জিনিসের প্রতি সনাতন হিন্দু ধর্ম তার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে প্রকৃতির প্রতি নিজের পূজা কে উৎসর্গ করে থাকেন। কালের আবর্তে পড়ে বর্বরদের হাতে পড়ে হিন্দু ধর্মের সেই সুপ্রাচীন নিয়ম আজও পাল্টে যাইনি। আজও প্রতিটি হিন্দু এই অম্বুবাচী পালন করে প্রকৃতির প্রকৃতি ও তার প্রতিটি জীবের প্রতি প্রেম শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে অর্পণ করে থাকেন।
৭ থেকে ১১ আষাঢ় (নিরয়ণ পঞ্জিকা মতে) চার দিন গ্রাম-বাংলার মহিলারা এই অনুষ্ঠান পালন করেন। চাষ বাসের কাজ এই সময় বন্ধ থাকে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে পিঠা-পায়েস বানাবার রীতি আছে। এই অণুষ্টানে বিধবা মহিলারা তিন দিন ধরে ব্রত রাখে।
অম্বুবাচীর আগের দিন রান্না করা খাবার তারা তিন দিন ধরে খান। ঐ তিন দিন তারা কোন গরম খাবার খান না। এই তিন দিন কামরুপ কামাখ্যায় পূজা হয়। সমস্ত দেবী মন্দির বন্ধ থাকে।
ওড়িশায় এই পার্বণকে সরাসরি ‘রজ উৎসব’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পঞ্চ ভূত এই দিয়ে প্রকৃতির প্রতিটি জিনিস তৈরি । পঞ্চভূত হল- মৃত্তিকা, জল ,অগ্নি , বায়ু , ,শূন্য ।মৃত্যুর পর প্রতিটি মানুষ প্রতিটি জীব এই পঞ্চভূতে লীন হয় ।পঞ্চভূতে গড়া এই পৃথিবীতে মাতৃজ্ঞানে সেবা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
কারণ বসুধা মাথা কখনো নিজের ভালোর চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন না। তিনি নিজেকে সর্বৈব নিজের সন্তানদের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করে চলেছেন । গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যিনি সর্বভূতহিতেরতা , তিনি তার পরম বন্ধু অর্থাৎ যিনি নিজের স্বার্থ চিন্তা না করে বসুধার নেয় প্রতিটি জীবকুলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন তিনি পরমেশ্বরের প্রিয় পাত্র।
শ্রী শ্রী চন্ডী মন্ত্রে আমরা উচ্চারণ করে থাকি
“যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥”
অর্থাৎ যে দেবী সর্বভূতের মাঝে মা রূপে শক্তিরূপে অবস্থান করেন তাকে আমাদের প্রণাম জানাই।
সুপ্রাচীন কাল থেকে তাই বৈদিক ঋষিরা সমগ্র বিশ্বজগতের কল্যাণের জন্য মন্ত্র উচ্চারণ করতেন।
ভূমি-মঙ্গলম / উদক-মঙ্গলম / অগ্নি-মঙ্গলম / ভ্যু-মঙ্গলম/ গগনা-মঙ্গলম / সূর্য- মঙ্গলম/ চন্দ্র মঙ্গলম / জগ-মঙ্গলম/ জীবন-মঙ্গলম / দেহা-মঙ্গলম / মানো-মঙ্গলম /আত্মা-মঙ্গলম / সর্ব-মঙ্গলম ভবতুহ ভবতুহ ভবতুহ স্বাহা সর্বমঙ্গলম ভবতুহ ভবতুহ ভবতুহ স্বাহা ভবতুহ ভবতুহ……
অম্বুবাচীর সময় হিন্দু ধর্মীয় লোকেরা শক্তি পূজার স্থানগুলোতে এই সময় অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করে থাকে। তবে এদের মধ্যে সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভারতের অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের কামাখ্যা দেবীর মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বৎসর অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করা হয়। অম্বুবাচী শুরুর প্রথম দিন থেকে কামাখ্যা দেবীর দ্বার বন্ধ রাখা হয় ফলে অম্বুবাচীর সময় দেবী দর্শন নিষিদ্ধ থাকে।
চতুর্থ দিন দেবীর স্নান ও পূজা সম্পূর্ণ হওয়ার পর কামাখ্যা মাতার দর্শন করার অনুমতি দেওয়া হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের থেকে আসা লক্ষ লক্ষ ভক্তেরা৷ এই সময় কামাখ্যা মন্দিরের চতুর্দিকে বসে কীর্ত্তন চলে৷ মন্দিরের বাইরে প্রদীপ ও ধূপকাঠী জ্বালিয়ে দেবীকে প্রনাম করেন।
অম্বুবাচী নিবৃত্তির দিন পান্ডারা ভক্তদের রক্তবস্ত্র উপহার দেন। দেবী পীঠের এই রক্তবস্ত্র ধারণ করলে মনোস্কামনা পূর্ণ হয় বলে ভক্তেরা বিশ্বাস করেন। এই রক্তবস্ত্র পুরুষেরা ডানহাত বা গলায় ও মহিলারা এই বস্ত্র বাওহাত বা গলায় পরিধান করে থাকেন। রক্তবস্ত্র পরিধান করে শশ্মান বা মৃতের ঘরে যাওয়া নিষিদ্ধ। কামাখ্যা ধামের অম্বুবাচী মেলা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
Post a Comment