বিদ্রোহের সংকেত দেওয়ায় তিনশ বছর নির্বাসিত হয় যে ঘণ্টা

Odd বাংলা ডেস্ক: প্রাচীনকাল থেকেই অপরাধের জন্য মানুষের বিভিন্ন প্রকার শাস্তির বিধান ছিল। সমাজ, সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে শাস্তির বিধানও বিভিন্ন প্রকার হতো, এটাই স্বাভাবিক। তবে এমনটা জানলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন জড় বস্তুর শাস্তির জন্যও কঠিন শাস্তি দেয়ার উদাহরণও আছে। একটি ঘণ্টাকে বিদ্রোহের সংকেত দেয়ায় শাস্তি হিসেবে নির্বাসিত করা হয় তিনশ বছর। এ ঘণ্টাকে শাস্তি দেয়ার কাহিনির সূত্রপাত রাশিয়ার জার চতুর্থ ইভানের পুত্রের মৃত্যুকে ঘিরে।

রাশিয়ার জার চতুর্থ ইভান ১৫৮৪ সালে মৃত্যু বরং করেন। চতুর্থ ইভান মানুষ হিসেবে খুবই ভয়ঙ্কর ছিলেন। সে কারণেই তিনি ইভান দ্য টেরিবল বলেও পরিচিত। উত্তরাধিকার হিসেবে চতুর্থ ইভান দুই পুত্র সন্তান রেখে যান। তবে তাদের দুজনের একজনও পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন না। তাদের একজন ছিলেন ফিওদর ইভানোভিচ। তিনি তার ভয়ঙ্কর পিতার ছায়ায় বেড়ে উঠেছিলেন। মাতৃস্নেহ থেকেও ছিলেন দূরে। ফিওদর শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির ছিলেন। তিনি সম্পূর্ণ পিতার বিপরীত প্রকৃতির ছিলেন। ফিওদর একজন ধার্মিক যুবক ছিলেন। গির্জা ঘুরে দেখা ও প্রার্থনা করে সময় কাটাতেই ভালোবাসতেন তিনি।

আর চতুর্থ ইভানের মৃত্যুর সময় তার অন্য ছেলে দিমিত্রি ইভানোভিচ ছিল মাত্র তিন বছরের শিশু। জার ইভানের একজন যোগ্য উত্তরাধিকার ছিল তার বড় ছেলে ইভান ইভানোভিচ। তবে মৃত্যুর তিন বছর আগে ইভান দ্য টেরিবল তার বড় ছেলের উপর প্রচণ্ড রেগে মাথায় আঘাত করেছিলেন। এর ফলে তার মৃত্যু হয়। যে কারণে সিংহাসনের কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকায় ইভান দ্য টেরিবল বোরিস গডুনভকে ফিওদরের রিজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফিওদরের পক্ষে গডুনভের হাতেই চলে যায়। সেসময় তিন বছর বয়সী দিমিত্রিকে তার মায়ের সঙ্গে মস্কোর উত্তরে প্রায় ১২০ মাইল দূরে উগলিচে নির্বাসিত করা হয়েছিল।

এসব ঘটনার প্রায় সাত বছর পর ১৫৯২ সালে দিমিত্রিকে উগলিচে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার মৃত দেহ গলা কাটা অবস্থায় ছিল। দিমিত্রির সমর্থকরা এর মধ্যে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায় এবং উগলিচের গ্রেট বেল (ঘণ্টা) বাজিয়ে বিদ্রোহের ডাক দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে বোরিস গডুনভকে সবাই সন্দেহ করে। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ সহিংস দাঙ্গা। এ সময় ক্রুদ্ধ নাগরিকরা মস্কো সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধিসহ দিমিত্রির খুনি সন্দেহে অন্তত পঞ্চাশ জনকে হত্যা করে। গডুনভ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎক্ষণাৎ সৈন্য প্রেরণ করেন। সৈন্যদের উপস্থিতিতে বিদ্রোহীরা দ্রুত পালিয়ে যায়। অনেক দাঙ্গাকারীকে গ্রেফতার করা হয়। তবে অবাক করা বিষয় হলো এ ঘটনায় সংকেত দেয়া ঘণ্টাও ছাড় পায়নি। সেটিও সৈন্যরা দখলে নিয়েছিল।

রাশিয়ান অর্থোডক্স বিশ্বাস অনুযায়ী, ঘণ্টাধ্বনিদের আত্মা থাকে এবং যেহেতু শুধুমাত্র জীবিত প্রাণীর আত্মা থাকতে পারে তাই ঘণ্টা জীবিত এবং অনেকটা মানুষের মতো বিবেচিত হয়। বিশেষত গির্জার ঘণ্টা একসময় গ্রামের বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতো। ঘণ্টার মানুষের মতো নাম দেয়া হতো এবং মানব দেহের অংশগুলোর মতো ঘণ্টার বিভিন্ন অংশের নাম দেয়া হতো। সে হিসেবে রাশিয়ার একটি ঘণ্টায় মাথা, কোমর, ঠোঁট, জিহ্বা, কান সবই থাকতো। আর গির্জার ঘণ্টাধ্বনিগুলোর ভুল সময়ে বা ভুল ব্যক্তির জন্য বাজায় মানব অন্যায়কারীদের মতো বিচার করে শাস্তি দেয়া হতো।

ঘণ্টাধ্বনির সাহায্যে দিমিত্রির মৃত্যুর কারণে সৃষ্ট দাঙ্গায় বিদ্রোহীরা সংঘটিত হয়েছিল। তাই দাঙ্গা প্ররোচিত করার জন্য উগলিচের ঘণ্টাটিকেও দায়ী করা হয়। গডুনভ উগলিচের ৩২০ টনের এই ঘণ্টাটি শহরের মধ্যে নামিয়ে আনতে আদেশ দেন। সেখানে রাখার পর কামারকে ঘণ্টা-তাড়নী সরিয়ে ফেলতে আদেশ দেয়া হয়, যা ঘণ্টার জিভ ছিঁড়ে দেয়ার সমতুল্য বলে বিবেচিত হতো। এর ধাতব অতিরিক্ত অংশ কান হিসেবে কেটে দেয়া হয়। এখানেই ঘণ্টার শাস্তি শেষ নয়। গডুনভ যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করারা জন্য ঘণ্টাটিকে ভারী চাবুকের সাহায্যে আঘাত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপরে দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে ঘণ্টাটিকেও সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। উগলিচ থেকে প্রায় ৬০টি পরিবারের সদস্য এই বিশাল ওজনের ঘণ্টাটি এক বছরে ১৪০০ মাইল দূরের টোবলস্কে নিয়ে গিয়েছিল।

উগলিচের এ ঘণ্টা টোবলস্কে পৌঁছানোর পর, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ একটি কক্ষে তালাবদ্ধভাবে আটকে রাখে। এখানেই শেষ নয়। এরপর এটির উপর শিলালিপিতে লিখে রাখা হয়- ‘উগলিচ থেকে প্রথম নির্জীব নির্বাসন’। বেশ কয়েকবছর ঘণ্টা সেখানেই তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছিল। এরপর সেন্ট সোফিয়া ক্যাথেড্রালে সময় নির্ণয় এবং অগ্নিকাণ্ডের সংকেত হিসেবে পুনরায় ঘণ্টাটির ব্যবহার শুরু হয়।

তবে তখনও এর নির্বাসন শেষ হয়নি। তিনশ বছর এর নির্বাসন আদেশ বহাল ছিল। ১৮৯২ সালে উগলিচের এ ঘণ্টার নির্বাসনের ৩০০তম বার্ষিকী উপলক্ষে সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডারের পক্ষ থেকে ঘণ্টাটিকে ক্ষমা করা হয় এবং নির্বাসন শেষে পুনরায় উগলিচে ফেরানোর অনুমতি দেয়া হয়। এরপর উগলিচ বাসীদের একটি প্রতিনিধি দল ঘণ্টাটি আবার উগলিচে নিয়ে যায়। সেসময় থেকে এটি এখনও উগলিচেই রয়েছে।

উগলিচের ঘণ্টার শাস্তির বিষয়টি খুবই অদ্ভুত। তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন জগতে পারে যে তাহলে রাজপুত্র দিমিত্রির মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল। মূলত এ ঘটনার সঠিক কারণ জানা যায়নি। এটা নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। অনেকে মনে করেন ফিওদর শাসন কাজ পরিচালনার অযোগ্য ছিলেন আর সিংহাসনের একমাত্র প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন দিমিত্রি। তাই গডুনভ দিমিত্রিকে সরিয়ে দিয়ে সিংহাসনের জন্য নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পারতেন। সে কারণে তিনিই দিমিত্রিকে হত্যা করেন। তবে অনেকেই এই মত গ্রহণ করেননি। তারা মনে করেন, দিমিত্রি সিংহাসনের আইনত অধিকারী কখনই ছিল না। তারা যুক্তি হিসেবে বলেছেন, চতুর্থ ইভানের পঞ্চম স্ত্রীর (বা সম্ভবত সপ্তম স্ত্রীর) সন্তান ছিল দিমিত্রি। এ কারণেই সে সিংহাসনের জন্য বৈধ ছিল না। কারণ রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ সর্বোচ্চ তিনটি বিবাহের অনুমতি দিয়েছিল।

তবে দিমিত্রির মৃত্যু স্রেফ দুর্ঘটনাক্রমে হয়েছিল সেটাও বলা যায় না। আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন, দিমিত্রি মৃগী রোগে ভুগছিলেন। যে কারণে হয়তো রোগ বেড়ে যাওয় ছুরি নিয়ে খেলার সময় দুর্ঘটনাক্রমে নিজের গলায় আঘাত পেয়ে মৃত্যু বরণ করে।

শাস্তি পাওয়া অন্যান্য ঘণ্টা

উগলিচের ঘণ্টার শাস্তি কার্যকর করা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ঘণ্টা রাশিয়ায় ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হতো এবং তাদের বিচার ও শাস্তি দেয়া হতো। একটি শহর দখলের পরে প্রায়শই তাদের টাওয়ার থেকে ঘণ্টা নামিয়ে আনা হতো। ১৩২৭ সালে মঙ্গোল-তাতার কর আদায়কারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমন করার পর মুসকোভি প্রিন্স ইভান প্রথম দানিলোভিচ কালিতা (১২৮৮-১৩৪০) শহরটি ধ্বংস করে ঘণ্টাটি দখল করেন। দানিলোভিচ এটি মস্কোতে নিয়ে শাস্তি হিসেবে গলিয়ে দেয়ার আদেশ দেন।

একইভাবে মস্কোর তৃতীয় ইভান ন্যভগরদ জয় করার পরে সেখানকার ঘণ্টা ধ্বংস করেছিলেন। শুধু এগুলোই নয় ঘণ্টার শাস্তি দেয়ার এমন উদাহরণ সে সময় আরো তৈরি হয়েছিল।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.