বিয়ের দিনকেই আত্মহত্যার জন্য বেছে নেয় নিরো

Odd বাংলা ডেস্ক: রোমান সাম্রাজ্য বহু কারণেই বিতর্কের তুঙ্গে। কয়েকশ শতক পেরিয়ে গেলেও সেসব পুরনো হয়নি এখনো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কের ডালপালা মেলে রয়েছে টা হচ্ছে রোম যে দিন পুড়ছিল, তখন নিরো আপন মনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। রোমান সম্রাট নিরোর নাম কিংবা তাকে নিয়ে সেই বিখ্যাত উক্তি শোনেননি, এমন মানুষ বিরল। জুলিও-ক্লডিয়ান রাজতন্ত্রের সবচাইতে কুখ্যাত এ সম্রাট আত্মহত্যা করেছিলেন মাত্র ৩০ বছর বয়সে। ক্লডিয়া অক্টাভিয়াকে বিয়েও করেছিলেন একই দিনে ৫৩  খ্রিষ্টাব্দে।

দু'হাজার বছরেও বিস্মৃত হয়নি তার নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। সৎ বাবা সম্রাট ক্লডিয়াসের মৃত্যুতে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সম্রাট হন নিরো। তার শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছর ছিল রোমানদের স্বর্ণযুগ। মন্ত্রণা পরিষদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি, গোপন বিচারের নামে হত্যা ও দুর্নীতি কমিয়ে আনা, খেলাধুলা ও বিনোদনভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজনসহ নানা কারণে রোমানদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন নিরো। 

১৫ ডিসেম্বর, ৩৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নিরোর। মায়ের সাহায্যে ক্ষমতায় এসেছিলেন নিরো। তার মা এগ্রিপিনা দ্য ইয়াঙ্গার ছিলেন প্রথম সম্রাট অগাস্টাসের সরাসরি বংশধর। তার ভাই সম্রাট ক্যালিগুলা- নিরোর পূর্বে যিনি পরিচিত ছিলেন সবচাইতে অত্যাচারী রোমান সম্রাট হিসেবে, তার সৎ পিতামহ টিবেরিয়াসকে হত্যা করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। জুলিও-ক্লডিয়ান পরিবারের ইতিহাস ছিল ভাতৃহত্যায় সমৃদ্ধ আর টিবেরিয়াসের মৃত্যু ছিলো এর সূচনা। নিরোর জন্মের পর ক্যালিগুলা তার বোন এগ্রিপিনার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে একটি ছোট্ট দ্বীপে নির্বাসিত করেন। শিশু নিরোর শিক্ষক হিসেবে এক নর্তকীকে নিয়োগ করেন। তখনকার যুগে নর্তকী বা অভিনেতাদের সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত নিচু। অত্যাচারী ক্যালিগুলার অধীনে শিশু নিরোর বেঁচে থাকা অনেকটা অসম্ভব ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, সে অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায় ক্যালিগুলার আকস্মিক মৃত্যুতে। যার ফলে পরবর্তীকালে আমরা দেখা পাই ভয়ংকর 'সম্রাট নিরো'র।

এদিকে নিজের দেহরক্ষীদের হাতে একদিন আচমকাই খুন হয়ে যান ক্যালিগুলা। তারপর যা হয় , পথের কাঁটা সরিয়ে রোমের সিংহাসনে বসেন তার বাবার সৎ ভাই ক্লডিয়াস।রাজা হিসেবে ক্লডিয়াস নেহাত মন্দ ছিলেন না। অন্তত আগের রোমান সম্রাটদের মতো রক্তপিপাসু আর পাশব চরিত্রের ছিলেন তিনি। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন অবৈধ যৌন সম্পর্ক আর ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে তিনি নিজের আগের স্ত্রী মেসালিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বিয়ে করলেন নিজেরই ভাইঝি এগ্রিপিনা দ্য ইয়ঙ্গার'কে । প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাসের বংশধর এই এগ্রিপিনা। তার ধমনিতেও বইছে নীলরক্ত। রাজকীয় উচ্চাশার পাশাপাশি কূটবুদ্ধি আর হিংস্রতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ক্লডিয়াসকে সরিয়ে নিজের ছেলে নিরোকে রোমের সিংহাসনে বসানোই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় রানি এগ্রিপিনার। নতুন বউয়ের চাপে পড়ে সৎ ছেলে নিরোকে দত্তক নিতে বাধ্য হন ক্লডিয়াস।

নিরোর নাম শুনেই সেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে নিশ্চয়? রোম যখন আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, তখন নিরো কি সত্যিই আপন মনে বাঁশি বাজাচ্ছিল! সে প্রশ্নের সঠিক জবাব এখনো পাওয়া যায়নি ইতিহাসের কোথাও। মায়ের আদরে-প্রশ্রয়ে ছেলেবেলা থেকেই উচ্ছন্নে গেছিল নিরো। রাজ্য পরিচালনার চেয়ে অভিনয়, সুর আর সুরাতেই তার আগ্রহ ছিল বেশি। একইসঙ্গে তার ভেতর জন্ম নিচ্ছিল এক ভয়ানক নিষ্ঠুর ব্যক্তিত্বের। সৎ ছেলে হলেও রাজার সন্তানদের মধ্যে বয়সে নিরোই ছিলেন বড়। তাই ক্লডিয়াসের পর নিরোই ছিলেন রাজসিংহাসনের দাবিদার। স্ত্রীর পরামর্শে ক্লডিয়াস তার পুত্র ব্রিটানিকাসের পাশাপাশি নিরোকে উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। এমনকি একমাত্র কন্যা ক্লডিয়া অক্টাভিয়ার সঙ্গে বিয়ে দিতেও রাজি হন।

এদিকে তর সইছিল না রানি এগ্রিপিনার। অনেকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলেন তিনি। রাজা ক্লডিয়াসকে খুন করতে হবে , আর এমনভাবে করতে হবে যাতে রোমান সেনেট বা প্রজারা কিছুই বুঝতে না পারে। আর তাই গোপনে বিষপ্রয়োগ করে খুন করার বুদ্ধিই আঁটলেন তিনি। তবে পরিকল্পনাটা সহজেই পাওয়া গেলেও কাজটা মোটেও সোজা ছিল না।

বয়স্ক হলেও অসম্ভব বুদ্ধিমান আর দূরদর্শী ছিলেন রাজা ক্লডিয়াস। রাজপরিবারের ঘৃণ্য রাজনীতিও তার অজানা ছিল না। তাই বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের পাশাপাশি তার সঙ্গে সবসময় থাকত একদল খাবার পরীক্ষক। যেকোনো খাবার রাজা খাওয়ার আগে তা খেতে হত সেই পরীক্ষকদের। এতেও নিশ্চিন্ত ছিলেন না রাজা। তিনি জানতেন টাকার লোভ দেখিয়ে রাজকর্মচারীদের কিনে নেয়া ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে অসম্ভব নয় মোটেই। তাই খাবারে বিষ থাকলেও যাতে তা পাকস্থলী অব্দি পৌঁছতে না পারে, তাই খাওয়ার পর গলায় পালক ঢুকিয়ে বমি করার অভ্যেসও ছিল রাজার। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি রাজার। বিষ প্রয়গে হত্যা করা হয় তাকে। সিংহাসনে বসেন নিরো। অত্যাচারের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল সেও। তবে এর মাঝে অনেক ভালো কিছু কাজ করে প্রজাদের মন জয়ও করেছিল নিরো।

কর কমানো ও দাস অধিকার বৃদ্ধি তার জনপ্রিয়তা আরো উসকে দেয়। খেলাধুলার নামে প্রাণী হত্যা ও রক্তক্ষয়ী গ্ল্যাডিয়েটর কমব্যাট বন্ধ করে গ্রিক কুস্তি চালু করেন তিনি। এসব কারণে তার সকল পাগলামি সত্ত্বেও লোকজন তাকে পছন্দ করত। বিখ্যাত সম্রাট ট্রাজান, নিরোর শাসনামলের প্রথম পাঁচ বছরকে উল্লেখ করেছেন রোমানদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসনামল হিসেবে। কিন্তু সহিংসতা আর নিষ্ঠুরতার পূজারী নিরোর আসল রূপ ফুটে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। রাজনৈতিক খুন, লাম্পট্য, খ্রিষ্টানদের উপর অমানবিক অত্যাচার নিরোকে শীঘ্রই পরিণত করে একজন অত্যাচারী সম্রাটে। 

নিরো তার মাকেও হত্যা করেছিল। যদিও নিরো তার মাকে ভালোভাবেই চিনতেন। নিজের স্বার্থ উদ্ধারে নিজের সন্তানকেও সরাতে পারেন তিনি। তাই এগ্রিপিনাকে নৌকাডুবিতে হত্যা করার চেষ্টা করেন নিরো। এগ্রিপিনা কোনোভাবে সেখান থেকে বেঁচে ফিরলেও নিরো তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পেরে এগ্রিপিনা নিজের পেটের দিকে ইশারা করে চিৎকার করেন- আমাকে এখানে ছুরিকাঘাত করো, যেখানে এক দানব বেড়ে উঠেছিল! ২৩ মার্চ, ৫৯ খ্রিষ্টাব্দ মারা যান এগ্রিপিনা।

এর পরবর্তী বছরগুলোতে নিরো রাজকার্য ছেড়ে দিয়ে সঙ্গীত-অভিনয়-নারীসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি অলিম্পিকেও অংশগ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য, তার অংশগ্রহণ করা সবগুলো ইভেন্টে তিনিই বিজয়ী হয়েছিলেন। ৬২ খ্রিষ্টাব্দ। নিরোর উপপত্নী পপেয়া সাবিনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। অথচ নিরো তখনো সম্ভ্রান্ত ক্লডিয়া অক্টাভিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। কলঙ্ক এড়াতে নিরো ক্লডিয়ার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে তাকে নির্বাসনে পাঠান। রোমের জনগণ এর বিরোধিতা করায় তিনি ক্লডিয়াকে হত্যা করেন। প্রথমে নিজের মা, তারপর স্ত্রী। নিরোর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। একই বছরে তার প্রিয়পাত্র ও প্রিটোরিয়ান রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্যুরোস মারা যান। যিনি নিরোর সমস্ত কুকর্মের সাহায্যকারী ছিলেন এবং তাকে আগলে রাখতেন। তবে এসব নয়, নিরো কুখ্যাত হয়ে আছেন অন্য কীর্তির জন্য।

৬৮ খ্রিষ্টাব্দ, ৯ জুন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিরো নিজেকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আবিষ্কার করেন। নিরো প্রথমে তাকে সাহায্য করার জন্য ও পরে হত্যা করার জন্য চিৎকার করেন। ভবিতব্য বুঝতে পেরে সকলেই নিরোকে ছেড়ে গিয়েছিল। উন্মাদ রাজা বিলাপ শুরু করেন,"আমার কি কোনো বন্ধু নেই, শত্রুও নেই?" কিন্তু না, বন্ধু না থাকলেও শত্রুর অভাব ছিল না নিরোর। পরিস্থিতি অনুধাবন করে তিনি পালিয়ে যান ও নিস্তার অসম্ভব বুঝতে পেরে শেষমেশ আত্মহত্যা করেন আত্মপ্রেমে বুঁদ এই সম্রাট। মৃত্যুর আগে তিনি বিড়বিড় করছিলেন, "আহ, আমার সঙ্গে সঙ্গে কত বড় একজন শিল্পীর মৃত্যু হলো!"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.