ভাস্কো-দা-গামা কোনও হিরো ছিলেন না, ভারতীয়দের খুন করেছিলেন এই খলনায়ক

Odd বাংলা ডেস্ক: বিখ্যাত পর্যটক ভাস্কো দা গামা প্রথম ইউরোপীয়, যিনি সম্পূর্ণ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপ থেকে ভারতে আসেন ২০ মে ১৪৯৮ সালে। তবে এলেন , দেখলেন , জয় করলেন, ভাস্কোর ক্ষেত্রে বিষয়টা একেবারেই এমন ছিল না। অনেক বিতর্ক জড়িয়ে ভাস্কো দা গামার ভারতে আগমন নিয়ে। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় নানা বিতর্কের ব্যাপারে। তবে ভারতে বিদেশি ঔপনিবেশিকতার পথ খুলে দিয়েছিলেন এই পর্তুগিজই। ভারতের বাতাস, জীবন ব্যবস্থা ভালোবেসেও ফেলেছিলেন। মৃত্যুও হয় বাংলার মাটিতে। তার প্রাণহীন দেহ দেশে ফিরেছিল প্রায় দেড় দশক পর। 

কোচির গির্জায় গেলেই দেখা মিলবে দা গামার শেষ চিহ্নের। ভাস্কো দা গামা নৌবহর নিয়ে ভারতের কালিকটের কাছেই অবস্থিত কাপ্পাডুতে এসে উপস্থিত হন। পর্তুগিজদের ভারতে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থোপার্জন ও ঐশ্বর্য সংগ্ৰহ করা এবং খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার। কোনোটাই সেবার ঠিকমতো হয়নি।

এই মানুষটির জন্ম পর্তুগালের সিনেস শহরে। বাবা এস্তেভাঁও দা গামা ও মা ইসাবেল চড্রের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পড়াশোনা করেছেন গণিত ও জাহাজ চালনা বিদ্যায় ইভরা শহরে। একপর্যায় নৌ কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। ১৪৯২ সালে জন দ্বিতীয় সেতুবাল ও এলগার্ভ বন্দরে শান্তিকালীন পর্তুগালের জাহাজে ফ্রান্স জাহাজের আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে ভাস্কো দা গামাকে পাঠান, যা তিনি অল্প সময়ে ফলপ্রসূভাবে সম্পাদন করেন।

ভারতবর্ষের সঙ্গে তখনো ইউরোপের কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না। কারণ কেউ ইউরোপ থেকে ভারতে পাড়িই দেননি। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা প্রথম ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। তার ভ্রমণে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হয়ে যায়। পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধ গড়ে ওঠে।

ভাস্কোর ভারতে পৌঁছনোর সময় তৎকালীন কালিকটের রাজা সামুদিরি। সেই সময়ে তিনি তার দ্বিতীয় রাজধানী পোন্নানিতে ছিলেন। বিদেশি নৌবহর আসছে! খবর শুনেই তিনি কালিকটে ফিরে আসেন। বিশাল শোভাযাত্রার মাধ্যমে জাহাজের নাবিকদের অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।

ভাস্কো দা গামার পক্ষ থেকে রাজা সামুদিরিকে উজ্জ্বল লাল কাপড়ের চারটি জোব্বা, ছয়টি টুপি, চার ধরনের প্রবাল, বারোটি আলমাসার, সাতটি পিতলের পাত্রসহ একটি বাক্স, এক সিন্দুক চিনি, দুই ব্যারেল (পিপা) তেল এবং এক পিপা মধু উপহার দেওয়া হয়। তবে রাজা তার এ সকল উপহারের প্রতি তেমন একটা আকৃষ্ট হননি। 

সবই ভালো ছিল। ব্যবসা করতে চাইতেই রাজা বেঁকে বসেন। বলেই দেন সোনা কর দিয়ে ব্যবসা করতে হবে। এসব দিতে রাজি ছিলেন না তিনি। রাজার মুখে এ কথা শুনে ভাস্কো দা গামা অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হন। রাগান্বিত অবস্থায় তাই তিনি তার সঙ্গে জোর করে তিনজন নায়েব আর ষোলো জন জেলেকে ধরে নিয়ে যান। ১৪৯৮ সালের ২৯ আগস্ট ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দর থেকে লিসবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দেশে ফেরত যাবার সময় ভাস্কো প্রচুর লুঠ চালিয়ে যান ভারতে। ইতিহাস বলছে, তিনি জাহাজে তার অভিযানের খরচের ষাট গুণ বেশি জিনিস নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন।

পথে তাদের অজ্ঞাত মৌসুমি বায়ুর বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হয়। যার ফলে ২৩ দিনের পথ পাড়ি দিতে তাদের ১৩২ দিন লেগে যায়। ১৪৯৯ সালের ২ জানুয়ারি তিনি আধুনিক সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে এসে পৌঁছান। সেখানে তখন চার পাঁচতলা বাড়ি, প্রাসাদ, আর মিনারওয়ালা মসজিদ ছিল। সেখান থেকে রওনা দেন নিজ দেশের উদ্দেশ্যে। ৪ দিন পর ৬ জানুয়ারি তারিখ তিনি মালিন্দিতে পা রাখেন। ততদিনে তার সঙ্গে থাকা অর্ধেক ক্রু মারা গিয়েছে, জাহাজে থাকা অন্যান্য নাবিকেরা তখন স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত। এত অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে তাদের পক্ষে তিনটা জাহাজ চালানো অসম্ভব ছিল। তাই তাদের সঙ্গে থাকা সাও রাফায়েল নামক জাহাজটিকে ডুবিয়ে দিতে বলা হলো। আর সেখানকার ক্রুদের বাকি দুই জাহাজে ভাগ করে দেয়া হলো।

১৪৯৯ সালের ১০ জুলাই, বেরিও নামক জাহাজে মাধ্যমে তিনি পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে পৌঁছান। ততদিনে ভাস্কো দা গামার ভাই পাওলো ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারা দু’জন কিছুদিন সান্তিয়াগো দ্বীপে থাকেন। কিছুদিন পর তার ভাই মৃত্যুবরণ করেন। ভাইকে সমাহিত করে ভাস্কো দা গামা ২৯ আগস্ট লিসবনে যান। তাকে বীরের ন্যায় স্বাগত জানানো হয় এবং রাজকীয় অনুষ্ঠানের দ্বারা বরণ করা হয়। ডিসেম্বর মাসে পর্তুগালের রাজা তার জন্মস্থান সিনেসকে উপহার হিসেবে তার হাতে সমর্পণ করেন। যদিও সেটা নিয়ে তাকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল।   ১৪৯৯ সালে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল সিনেস শহরটি ভাস্কো দা গামাকে পুরস্কার হিসেবে প্রদান করেন।

১৫০২ সালে পর্তুগাল থেকে ভাস্কো দা গামার নেতৃত্বে ৪র্থ বহর রওনা দেয় ভারতের উদ্দেশ্যে। এ বহরের উদ্দেশ্য ছিল, কালিকটের রাজার উপর প্রতিশোধ নেয়া এবং পর্তুগিজরা যে শর্ত দেবে সেই মাফিক আত্মসমর্পণ করানো। ১৫০২ সালের অক্টোবরে তাদের বিশাল নৌবহর ভারতে পৌঁছাল। সেখানে ‘মিরি’ নামে এক জাহাজ আসছিল মক্কা থেকে। জাহাজটি ছিল হজ্জযাত্রীতে পরিপূর্ণ। ভাস্কো দা গামা সে জাহাজে আক্রমণ চালান এবং সেখানকার সকল যাত্রীকে জ্বালিয়ে দেন এবং জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন।

সব মিলিয়ে জাহাজে চারশোর মতো যাত্রী ছিলেন যাদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন নারী। তারা তাদের বাচ্চাদের ধরে প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন, কিন্তু ভাস্কো দা তাদের কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে তাদেরকে হত্যা করেন। তাদের সাথে থাকা স্বর্ণালঙ্কার লুট করেন। ভাস্কো দা গামার শর্ত মেনে নিতে রাজি হলেন কালিকটের রাজা। কিন্তু ভাস্কো দা গামা শহর থেকে সকল মুসলিমকে বের করে দেবার দাবি জানান। কালিকটের রাজা বলেন, হিন্দুদের মতো মুসলমানেরাও তার রাজ্যের নাগরিক।

তাই কোনোভাবে তার এ দাবি রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন। রাজার এ উত্তরে ভাস্কো দা গামা ভীষণভাবে ক্রোধান্বিত হন। তিনি তাই তার সঙ্গে থাকা নাবিকদের গোলাবর্ষণের নির্দেশ দেন। একটানা দুদিন গোলাবর্ষণের ফলে শহরের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ভাস্কো দা গামা কিছু ভারতীয় জাহাজ আটকে রেখে সেখানের নাবিকদের হাত, কান ও নাকসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে দেন এবং এ অবস্থায় তাদেরকে রাজার কাছে পাঠান।

রাজা তখন একজন ব্রাহ্মণকে পাঠালেন তার সাথে সমঝোতা করার জন্য, কিন্তু ভাস্কো দা গামা তাকে গুপ্তচর হিসেবে দাবি করেন এবং তার ঠোঁট ও কান কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। তার কান কেটে সেখানে সেলাই করে কুকুরের থেকে কেটে নেয়া কান লাগিয়ে দেয়া হয়। এরপর ভাস্কো দা গামা তাকে পাঠিয়ে দিলেন রাজার কাছে।

কালিকটের রাজা কোনোভাবে পর্তুগিজদের শর্ত মানতে চাইলেন না। ফলে ভাস্কো দা গামা কালিকটের রাজার সঙ্গে এক যুদ্ধে লিপ্ত হন যদিও এ যুদ্ধে ভাস্কো দা গামা জিতে যান। জাহাজ বোঝাই করে তিনি মশলাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তিনি লুট করেন এবং পর্তুগালে নিয়ে যান। পরের দু’দশক নীরব জীবন কাটালেন দা গামা। ১৫২৪ সালে পর্তুগিজ রাজা তৃতীয় জন ভাস্কো দা গামাকে ‘ভাইসরয়’ উপাধিতে ভূষিত করেন। একই বছরের এপ্রিলে তিনি আবার ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

এবার এসেই পর্তুগিজ শাসনাধীন ভারতের অঞ্চলগুলোতে নিজের পছন্দের লোকদের বসিয়ে দিলেন ক্ষমতায়, তিনি নিজেও ছিলেন অনেক ক্ষমতাবান। তবে ভারতে পা রাখার কয়েকমাস পর তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। মারা যান এখানেই। সেদিন ওই গির্জাতেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। ১৪ বছর পরে তার দেহ যায় লিসবনে। তবে আছে ডা গামার সমাধি ফলক। 

১৫০৩ সালে পর্তুগিজ পেড্রো আলভারেজ ডি ক্যাব্রাল একটি গির্জা তৈরি করান। আলভারেজ আগে এখানে একটি কেল্লা গড়েন এবং তার ভিতরেই তৈরি করেন এই গির্জা। কালিকটের রাজার অনুমতি নিয়েই তৈরি হয় এটি। তখন এর নাম সেন্ট বার্থোলোমিউ। গির্জাটি ছিল সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। ১৫১৬ সালে, বার্থোলোমিউ গির্জার সংস্কার করা হয়। নাম হয় সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। এখানেই রয়েছে ভাস্কোর ভারতে থাকার শেষ চিহ্ন।

জীবনের বেশিরভাগ সময় কাজের জায়গায় ভিলেনের ভূমিকা পালন করলেও কিছু উপকার করেছিলেন বিশ্ববাসীর। ভাস্কোই সেই পর্তুগিজ পর্যটক যিনি ৫২২ বছর আগে সমুদ্রপথে ইউরোপ থেকে ভারতে আসেন। প্ৰথম ইউরোপীয় ব্যক্তি যিনি সম্পূৰ্ণ সমুদ্র পথে ভারতে আসেন। তার আগমন এশিয়া এবং ইউরোপকে জুড়ে দিয়েছিল। তার এ ভ্ৰমণ এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগ করার পাশাপাশি আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের মাঝে সেতুবন্ধন রচিত করেছিল এবং এ দিক থেকে পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সংযোগ স্থাপনের অন্যতম কারিগর হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দেয়া যায়। 

১৮৬৯ সালে সিনাই উপদ্বীপে সুয়েজ খাল খননের পূর্ব পর্যন্ত নাবিকেরা ইউরোপ থেকে এশিয়াতে পৌঁছানোর জন্য তার দেখানো জলপথ অনুসরণ করতেন। ইউরোপিয়ান বণিকেরা এ শুল্ক প্রদানে তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না, এজন্য তাই ইউরোপ থেকে ভারত ও চীনসহ দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পৌঁছানোর জন্য এ সমুদ্রপথ তাদের নিকট অত্যাবশকীয় হয়ে ওঠেছিল।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.