Odd বাংলা ডেস্ক: কার্লোস ভালডারেমাকে এই প্রজন্মের ক’জন ফুটবলপ্রেমী চেনে? খুব বেশি নয় কিন্তু! অথচ ১৯৮০-৯০ এর দশকের এই মিডফিল্ডার ফুলানো ঝাকড়া চুল নিয়ে সারামাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন। কিংবা পাগলাটে গোলকিপিং করার জন্য বিখ্যাত রেনে হিগুইতার কথা বলাই যায়। এই দুই তারকা কলম্বিয়া নামক দেশটিকে বিশ্বের কাছে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এছাড়া কোকেন সম্রাট পাবলো এস্কোবার কলম্বিয়াকে আরও বেশি চিনিয়েছেন তার অপকর্মের মাধ্যমে।
আজকের বিষয়টা ঠিক কলম্বিয়া নয়, জলহস্তীর গল্প বলবো। কলম্বিয়ার শহর মেডেলিন থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে গ্রামীন পরিবেশে ২০বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে সুবিশাল এক থিমপার্ক। জুরাসিক যুগের ডাইনোসারের ভাষ্কর্য দিয়ে পার্কটি সুশোভিত করা হয়েছে। পাশাপাশি পার্কটি বন্যপ্রাণীদেরও কৃত্রিম আবাসস্থল। সেইসব বন্য প্রাণীদের মধ্যে অন্তত ৭০টি জলহস্তী রয়েছে। এর বেশিও হতে পারে। সুবিন্যস্ত জলাধার আর বছরব্যাপী বৃষ্টিপাত পার্কটিকে জলহস্তিদের অনুকুল এবং প্রিয় আবাসস্থল করে তুলেছে।
প্রাণীবিদ্যা নিয়ে যাদের কিছুটা হলেও জ্ঞান আছে, তারা জানেন যে, জলজস্তীদের এখানে থাকার কথা নয়। প্রাণী হিসাবে জলহস্তিদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বাসস্থান আফ্রিকার সাব-সাহার অঞ্চল; যা কলম্বিয়া থেকে বিশাল আটলান্টিক পেরিয়ে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই মহাসাগর পাড়ি দিয়ে কীভাবে কলম্বিয়ায় এলো এই জলহস্তি এবং কেনই-বা তারা ‘কোকেন জলহস্তী’ নামে কুখ্যাতি অর্জন করলো তাই নিয়ে এই গল্প।
ফিরে যেতে হবে গত শতকের আশির দশকে। কুখ্যাত মাদক সম্রাট মাফিয়া ডন, কোকেন সম্রাট পাবলো এস্কোবার তখন দাপিয়ে বেড়াতো পুরো কলম্বিয়া। তার মাদক নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে। মাদক এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে তিনি অর্জন করেছে অঢেল সম্পদ এবং গড়ে তোলে এক বিশাল মাদক সাম্রাজ্য। তার প্রকৃত সম্পদের পরমান সঠিকভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় সেই সময়েই এস্কোবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন। বর্তমানে এই সম্পদের পরিমাণ ৬৪ বিলিয়ন। কলম্বিয়ার ধনীদের তালিকায় শীর্ষে। তার প্রধান বাসগৃহ এবং গুপ্ত আশ্রয় ছিল বিলাশবহুল ‘হাসিয়েন্দা নেপোলিস’। এখানেই সে তার মাদক ব্যাবসায়ী বন্ধুদের সাথে পার্টিতে মেতে উঠতো। এখানেই শেষ নয়। অন্যান্য মাদক সম্রাটের মতোই পাবলো এস্কোবারের অবসর সময় কাটতো অদ্ভুত সব শখ পুরণের মধ্য দিয়ে।
ভয়ঙ্কর এই মাদক সম্রাট কলম্বিয়ায় গড়ে তোলে একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানায় চোরাচালানের মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সিংহ, গন্ডার, জিরাফসহ নানা প্রকার প্রাণী এনে জমা করা হয়। তার মধ্যে ছিল দুই জোড়া আফ্রিকান জলহস্তি। এস্কোবার এগুলোকে খুবই পছন্দ করতো। ১৯৯৩ সালে কলম্বিয়ান সরকার এস্কোবারকে জীবিত কিংবা মৃত ধরার জন্য কোকেন হান্ট অপারেশন শুরু করে। সেই বছরের ৩ ডিসেম্বর নিজের ৪৩তম জন্মদিনে এস্কোবার পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। মৃত্যুর পর এস্কোবার রবিনহুড রূপে আবির্ভূত হয় এবং পুলিশের বাধা সত্বেও তার অন্তেষ্টিক্রিয়ায় ২৫ হাজার কলম্বিয়ান উপস্থিত ছিলেন।
এস্কোবারের মৃত্যুর পর কলম্বিয়ান সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তার সব সম্পদ রাষ্ট্রীয় দখলে নেয়া হয়। সরকারি দখলে চলে যায় তার ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানাটিও। সরিয়ে নেয়া হয় বেশিরভাগ প্রাণী। তবে জলহস্তীদের সরিয়া নেয়া সম্ভব হয়নি। অন্যত্র রাখার জন্য ভালো ও উপযুক্ত কোনো জায়গা ও পরিবেশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এস্কোবারের মৃত্যু হয়েছে আজ ২৮ বছর কিন্তু কলম্বিয়াকে আজও তার স্মৃতিচিহ্ন ও কুকীর্তির ফলাফল বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
এরই মধ্যে জলহস্তীরা ব্যাপক বংশবিস্তার করেছে। ফলে দেখা দিয়েছে খ্যাদ্যের অভাব। সূর্য অস্ত গেলেই এরা জলাশয় ছেড়ে স্থলে চলে আসে। খাবারের খোঁজে লোকালয় পর্যন্ত হানা দেয় জলহস্তী। এরা প্রতিরাতে ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করে, যা স্থানীয়দের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, এরা পার্কের বাইরেও নতুন অবাসস্থল গড়ে তুলছে। এস্কোবারের পার্ক থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পশ্চিমে ককর্ণা নামে ছোট একটি শহর আছে, যা গড়ে উঠেছে ককর্ণা নামের নদীর ধার ঘেষেই। বর্তমানে এই নদীতেও একদল জলহস্তি প্রাকৃতিক পরিবেশে নিজেরাই আবাসস্থল গড়ে তুলেছে। এস্কোবারের এই জলহস্তীরা আজ কলম্বিয়ার জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলহস্তীগুলো কেন কলম্বিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ? বিষয়টি লুকিয়ে আছে এই প্রাণীর জৈবিক এবং বংশগতি প্রক্রিয়ার মধ্যে। বন্য পরিবেশে জলহস্তি ৪০ বছর বেঁচে থাকে এবং ৬/৭ বছর বয়সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়। যৌবনপ্রাপ্ত হাওয়ার পর আমৃত্যু একটি স্ত্রী জলহস্তি প্রতিবছর একটি করে সন্তান প্রসব করে। এতে দেখা যায় গড়পরতা একটি স্ত্রী জলহস্তি সারাজীবনে ৩০টির মতো সন্তান প্রসব করতে সক্ষম। এভাবে প্রতি ১০ বছরে এদের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে কয়েক দশকের মধ্যেই কলম্বিয়ায় এদের জনসংখ্যার বিস্ফারণ ঘটবে বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা!
জলজস্তীদের বলা হয় বাস্তুতন্ত্রের ইঞ্জিনিয়ার। এরা নিজেদের বাস্তুতন্ত্র নিজেদের মত করেই পরিবর্তন করতে সক্ষম। এদের নির্গত বর্জ্যে বাস্তুসংস্থানের ঘাস লতাপাতাতেও আসে পরিবর্তন। ফলে কলম্বিয়ার ওই অঞ্চলের স্থানীয় জলচর প্রাণীগুলো (যেমন টাপির, জায়ান্ট ভোদর, মানাটিস) এরই মধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে। যদি জলহস্তীরা এভাবে সংখ্যায় বাড়তে থাকে তাহলে স্থানীয় এসব প্রাণীর এই অঞ্চলে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে কোটি কোটি বছর ধরে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে। হঠাৎ কোনো প্রানীর অনুপ্রবেশ বাস্তুসংস্থানে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কলম্বিয়ার জলহস্তীরা। কলম্বিয়ার পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এখন দোটানায় আছে; এসব জলহস্তীদের এখানেই ইতি টানবে নাকি এদের এভাবেই বেড়ে উঠতে দেবে। কলম্বিয়ার জনগণ অবশ্য জলহস্তীদের এভাবেই থাকতে দেয়ার পক্ষে। কুখ্যাত পাবলো এস্কোবারের জীবনাবসান হয়েছে প্রায় ত্রিশ বছর। কিন্তু তার অপকীর্তির ফল এখনও ভোগ করতে হচ্ছে কলম্বিয়ার মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের...!
Post a Comment