Odd বাংলা ডেস্ক: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। যুদ্ধের রেশ কাটেনি এখনো। বুলগেরিয়া হেরেছিল এই যুদ্ধে। তবে বুলগেরিয়ার সঙ্গে গ্রিসের দ্বন্দ আজ থেকে নয়। এর বিরোধ বেশ পুরানো। এই দুটি দেশই একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। বিশেষ করে ম্যাসিডোনিয়ার দখল নিয়ে গ্রিস ও বুলগেরিয়ার মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। ম্যাসিডোনিয়া কার দখলে থাকবে তা নিয়ে গ্রিস এবং বুলগেরিয়ার মধ্যে প্রথমে একপ্রস্থ যুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুই’পক্ষ পরস্পরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। গ্রিস ঠিক করে তারা ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং ফ্রান্সের মিত্র শক্তিতে যোগ দেবে। পাল্টা বুলগেরিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জার্মানি, ইতালির সঙ্গে হাত মিলিয়ে অক্ষশক্তির হয়ে যুদ্ধ করার। গ্রিস প্রথমে মিত্র শক্তিতে যোগ দিয়েছিল বলেই বুলগেরিয়া অক্ষশক্তিতে সামিল হয়েছিল। না হলে তাদের অক্ষশক্তিতে যোগ দেওয়ার অন্য কোনো কারণ ছিল না।
তবে এবারের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অন্য কারণ রয়েছে। আর তা হচ্ছে একটি কুকুর। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন। একটি কুকুরের জন্য এই দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বেঁধেছিল ১৯২৫ সালে। গ্রিস সেনাবাহিনীর একটি কুকুর হঠাৎই সীমান্ত পেরিয়ে বুলগেরিয়ায় প্রবেশ করে, এর ফলে দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করায় এই যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গিয়েছেন, যে এই দুটি দেশ ঠিক কতটা একে অপরকে অপছন্দ করত। একজন যদি উত্তর দিকে যায় অন্যজন তবে দক্ষিণ দিকে, এটাই ছিল তাদের অবস্থান। কিন্তু পরপর এই দুটি যুদ্ধেই গ্রিসের কাছে পর্যদুস্ত হয় বুলগেরিয়া। এই নিয়ে সে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। তারা চাইছিল যে কোনো উপায়ে দেশের সম্মান পুনরুদ্ধার করা হোক।
এদিকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বুলগেরিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার স্ট্যামবোলিস্কি গ্রিসের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করার কাজ শুরু করেন। তার এই উদ্যোগের ফলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছিল। যদিও বুলগেরিয়ার জনসাধারণের মধ্যে সেই সময় জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ এতই চরম পর্যায়ে ছিল যে তারা প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ খোলা মনে মেনে নিতে পারেনি। সেইজন্য সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আলেকজান্ডার স্ট্যামবোলিস্কিকে তারা সরিয়ে দেয়।
এরপর থেকেই গ্রিস ও বুলগেরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আবার খারাপ হয়ে ওঠে। সীমান্ত অঞ্চলে প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তখন। এই সময় বুলগেরিয়া চাইছিল কোনো একটি ছুতায় গ্রিসকে আক্রমণ করতে। তবে সে দেশের সেনা কর্তারা এটাও বুঝেছিলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রিসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে আবার তারা হেরে যেতে পারেন। কারণ দেশের সামরিক পরিকাঠামো তখন অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে গ্রিসের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় সেইসময় ছিলেন স্বৈরশাসক প্যাঙ্গোলাস। তিনিও কিছুটা যুদ্ধোন্মাদ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে ১৯২৫ সালের ১৩ অক্টোবর সীমান্তে গ্রিসের একজন সেনা একটি কুকুরকে নিয়ে টহল দিচ্ছিলেন। ওই কুকুরটি সেনাবাহিনীরই ছিল। হঠাৎ করেই কুকুরটি তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বুলগেরিয়ার দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এদিকে অত কিছু না ভেবে গ্রিসের সেই সৈন্যটি বুলগেরিয়া মধ্যে ঢুকে পড়েন কুকুরের খোঁজে। তৎক্ষণাৎ তাকে ঘিরে ধরে হত্যা করে বুলগেরিয়ার সৈন্যরা। এই ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে ওঠে গ্রিস। তাদের বেশ কিছু সেনা পাল্টা আক্রমণ করে বুলগেরিয়ায়। এর পরের দিনই সীমান্তে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গ্রিসের সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন তার সঙ্গীকে নিয়ে সীমান্তের জিরো ডিগ্রি অঞ্চল বা নো ম্যানস ল্যান্ডে গিয়ে হাজির হন। তাদের হাতে সাদা পতাকা ছিল, যা দেখে সহজেই বোঝা গিয়েছিল তারা আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার অবসান ঘটাতে চাইছেন।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সমস্ত রীতিনীতি লংঘন করে বুলগেরিয়ার সেনারা গ্রিস সেনাবাহিনীর সেই ক্যাপ্টেনকেও হত্যা করে। এরপরই ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে যায় গ্রিসের স্বৈরাচারী শাসক প্যাঙ্গোলাস। তিনি বুলগেরিয়াকে চরমপত্র দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দু’লক্ষ ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ, প্রকাশ্যে এই ঘটনার জন্য বুলগেরিয়ার ক্ষমা প্রার্থনা এবং যে সমস্ত সেনা এই ঘটনায় জড়িত ছিল তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানান। জনসাধারণের ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখে বুলগেরিয়ার সরকার গ্রিসের এই সমস্ত দাবির একটিও পূরণ করেনি।
এর ফলে ৪৮ ঘন্টার চরম সময়সীমা পেরিয়ে যেতেই গ্রিস সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ায় প্রবেশ করে। তারা দ্রুত সেখানকার বেশকিছু শহর দখল করে নেয়। এই ঘটনায় বুলগেরিয়ার সেনা এবং সাধারন মানুষ মিলে ১০০ জনের মৃত্যু ঘটে। গ্রিসের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। এদিকে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে হেরে যাওয়ার ফলে সেই সময় গ্রিসের আর্থিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো ছিল না। তাই তাদের পক্ষে বুলগেরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালানো একরকম অসম্ভব ছিল। এই পরিস্থিতিতে বুলগেরিয়া জাতিসংঘের সাহায্য প্রার্থনা করলে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়।
জাতিসংঘ গ্রিসকে নির্দেশ দেয় তারা যেন অবিলম্বে বুলগেরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করে, না হলে সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানো হবে। এর ফলে গ্রিস দ্রুত বুলগেরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। পরে বুলগেরিয়ার কাছ থেকে মাত্র ৪০ হাজার ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পেরেছিল গ্রিস। এই যুদ্ধের নির্দিষ্ট পরিণতি না ঘটলেও এর কারণেই গ্রিসের স্বৈরশাসক প্যাঙ্গোলাসকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল।
Post a Comment