Odd বাংলা ডেস্ক: কুকুরকে পোষ মানানো বা কুকুরের সাথে মানুষের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রচলন বেশ পুরনো। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রেগর লারসনের নেতৃত্বে একটি দল মানুষের কুকুরকে পোষ মানানোর বিষয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণাপত্র থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, কুকুরকে পোষ মানানোর আদিম রীতির উৎপত্তিস্হল হিসেবে নির্দিষ্ট একটি জায়গার নাম বলা যায় না। তাঁরা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আদি পৃথিবীর উভয় প্রান্তে কুকুর পোষ মানানোর ইঙ্গিত পেয়েছেন। একটি ছিল পূর্ব ইউরেশিয়া অঞ্চল, আরেকটি পশ্চিম ইউরেশিয়া অঞ্চল। এতে মনে হচ্ছে, দুটি জনগোষ্ঠীই পৃথকভাবে বুঝতে পেরেছিল কুকুরকে পোষ মানানো সম্ভব।
এশিয়া অঞ্চলের কুকুরগুলো হচ্ছে এশিয়ার নেকড়েদের বংশধর। প্রায় সাড়ে বারো হাজার বছর আগে এই নেকড়েদেরকে পোষ মানানোর মাধ্যমে এশীয় কুকুরদের আগমন ঘটে। অন্যদিকে ইউরোপের কুকুরদের আদি বংশধর হচ্ছে পুরাতন প্রস্তর যুগের ইউরোপিয়ান নেকড়ে, যাদেরকে অন্তত পনেরো হাজার বছর পূর্বে মানুষ বশ্যতা স্বীকার করানোর চেষ্টা করেছিল এবং সময়ের পালাবদলে সেগুলো আজকের ইউরোপিয়ান কুকুরে পরিণত হয়েছে। এরপর প্রায় ছয় হাজার চারশো বছর পূর্বে এশিয়ান কুকুরগুলো মানুষের মাধ্যমেই ইউরোপে পৌঁছেছে এবং ইউরোপিয়ান প্রস্তরযুগের কুকুরকে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করেছে। কুকুরকে পোষ মানানোর ইতিহাস তাই বেশ পুরনোই বলা চলে।
কুকুর এবং মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক বেশ অদ্ভুত। কুকুরকেই একমাত্র প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা মানুষের এত কাছাকাছি দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে। কারণ হিসেবে সম্ভবত দুই প্রজাতির সামাজিক পরিবেশে একইসাথে অভিযোজনকে দায়ী করা হয়।
কুকুর মানুষের শরীরের অঙ্গভঙ্গী এবং চোখ দেখে বুঝতে পারে মানুষ কি চায়৷ আর সেজন্যই গাইড কুকুররা অন্ধ মালিকদের গন্তব্য বুঝতে পেরে তাদের সেখানে পৌঁছে দেয়৷ কুকুর হিংসা প্রকাশ করতে পারে। এদের আছে সহানুভূতি প্রদর্শনের গুণও। জীবজগতে কুকুরই সবচেয়ে ভালোভাবে মানুষের ভাষা বুঝতে পারে। মানুষের ভাষার ভিন্নতা কুকুরের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয় না। ভিডিওর শুরুতেই তিন ভাই-বোনের কুকুরের সাথে সখ্যতার কথা বলেছিলাম। তারা ডাক দিলে কাছে আসে, তাদের সাথে খেলে- মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির সহজাত এই ক্ষমতা কুকুর ভালভাবেই রপ্ত করেছে। কুকুর মানুষের না বলা কথাগুলোও বুঝতে পারে। মানুষের রাগ, অভিমান, কষ্ট সবই বোঝার ক্ষমতা রয়েছে কুকুরের। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সম্ভবত মানুষের সাথে কুকুরের হাজার বছর ধরে অভিযোজিত হওয়ার ফল।
কিছু গবেষণায় এসেছে, কুকুরের টিভি দেখতে পারার গুণের কথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনার পোষা কুকুর আপনাকে টিভির পর্দায় দেখে সহজে চিনতে পারলেও স্মার্টফোন বা ট্যাবে দেখলে আপনাকে চিনবে না। যুক্তরাষ্ট্রের টুফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিহেভারিস্ট নিকোলাস ডোডম্যান বলছেন, কুকুর যখন তার মনিব বা চেনা মানুষকে টিভির মতো বড় পর্দায় দেখে তারা ভাবে মানুষটা হয়ত টিভি স্ক্রিনের পেছনে রয়েছে। এজন্য অনেক সময় তারা টিভির পেছনে গিয়েও খুঁজে দেখতে চায় মানুষটিকে। কিন্তু মোবাইল ফোনের মত ছোট স্ক্রিনে মানুষের সাইজ ছোট থাকায় কুকুরের মস্তিষ্কের পক্ষে চেনা অবয়ব মেলানো কষ্টকর হয়ে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কুকুরের সাথে খেলা করার সময় মানুষের মস্তিষ্ক থেকে বিশেষ রাসায়নিক নির্গত হয়, যা ভালবাসার অনুভূতি দেয়। কুকুরের সংস্পর্শে আসলে মানুষের একাকিত্ব দূর হয়। কুকুরের ডাক শুনলে মানুষের মনে অদ্ভুত মায়ার সৃষ্টি হয়। কুকুরের খাবার খাওয়ার দৃশ্য মানুষকে মানসিক প্রশান্তি দেয়। এসবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে যাচ্ছেন। ব্যাখ্যা যাই হোক মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করার মতো দ্বিধাহীনতার এই সময়ে কুকুরকে মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে কাছে টানছে, করে তুলেছে পরম বন্ধু।
ইতিহাস বলছে, সেই আদিম সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে কুকুর সবসময় মানুষের কাছাকাছি থেকেছে। শিকার, পশু পাহারা দেয়া, বাড়ি পাহারা দেয়া থেকে শুরু করে যেকোনো বিপদ-আপদে কুকুর মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কুকুর আর মানুষের বন্ধুত্ব নিয়ে গল্প-কাহিনী আর সিনেমারও কোনো অভাব নেই।
এমন কথার প্রচলনও শোনা যায়, কুকুর পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী যে কি না নিজের চাইতেও তার মনিবকে বেশি ভালবাসে।
অনেক গবেষকের মতে, কুকুরের এই প্রভুভক্তির পেছনে লাভ হরমোনের প্রভাব রয়েছে। কুকুর যখন তার চেনাজানা মানুষের আশেপাশে থাকে, তখন তাদের মধ্যে অক্সিটোসিন হরমোনের উৎপাদন এবং প্রবাহ বেড়ে যায়। আর যখন মনিবের সাথে তাদের চোখাচোখি ঘটে, তখন কুকুরের মধ্যে অক্সিটোসিনের বিস্ফোরণ ঘটে।
গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে , একটি কুকুরের মস্তিষ্কে যখন অক্সিটোসিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে, তখন সে তার মনিবের সামাজিক আচরণের সাথে ভালোভাবে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। আর একটি কুকুর যত বেশি সময় তার মনিবের দৃষ্টিসীমার মধ্যে অবস্থান করে, তার মধ্যে লাভ হরমোন প্রবাহের হার তত বেশি বেড়ে যায়।
কুকুরের মস্তিষ্ক এম. আর. আই. স্ক্যানারে স্ক্যান করে হাঙ্গেরির বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষ নিজেরা যেভাবে সাড়া দেয় কুকুরও ঠিক একইভাবে সাড়া দিচ্ছে। এই সাড়া দেয়ার ব্যাপারটি সবচেয়ে বেশি ঘটে তারা যখন আবেগ মেশানো কোনো শব্দ যেমন হাসি বা কান্না শুনতে পায়।
হাঙ্গেরির ইয়োতভোস লোরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর যখন বাজিয়ে শোনানো হয়েছে, তখন মানুষ ও তাদের পোষা প্রাণী- উভয়েরই মস্তিষ্কের ওপরের অংশের একই জায়গা একটিভ বা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হাসির শব্দেও এই দুটো প্রাণীর মস্তিষ্কে প্রায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির ইথোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. অ্যাটিলা অ্যানডিচ বলছেন, কুকুর যে মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু তার কারণ হয়তো এটাই।
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী জর্জ বার্নস বলেন, কুকুরের খাবার আসে সাধারণত মানুষের দেওয়া খাবার কিংবা ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট থেকে। যখন কুকুরকে খাবার দেওয়া হয়, তখন তার মস্তিষ্কে বিশেষ আবেগী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। যে-ই খাবার দিক, সেটি কুকুরের কাছে মুখ্য নয়, খাবার যার কাছে পাচ্ছে, তার সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠতা।
জর্জ বলেন, কুকুর মূলত খাবারের জন্যই মানুষের বন্ধু হচ্ছে এটি যেমন ঠিক, তেমনি মানুষও কিন্তু আরেক মানুষের বন্ধু হচ্ছে সামাজিক বন্ধন ও সুবিধার জন্যই। তাই কুকুরের এ আচরণকে সুবিধাবাদী বলেও দোষ দেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই দেখা যায়, মানুষ কুকুরকে নিজের সন্তানের মত ভালবেসে লালন-পালন করে। কুকুরের পেছনে অনেক পয়সা খরচ করে। শীতকালে কুকুরের জন্য আলাদা গরম জামা-কাপড় কেনে। কুকুরের অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কুকুর যেন হয়ে ওঠে পরিবারেরই একজন। অনলাইনে একটি গল্প বেশ প্রচলিত। একজন তার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কুকুরের জন্য এত কষ্ট করো, সময় দাও, পয়সা খরচ করো কেন? তুমি ইচ্ছা করলেই তো কোনো সুবিধা বঞ্চিত শিশুকে দত্তক নিতে পার। তাহলে তোমারও ভাল লাগত আর একজন সুবিধা বঞ্চিত মানুষ পৃথিবীর আলো দেখতে পেতো তোমার উছিলায়। তার জবাব খুব সংক্ষিপ্ত ছিল, “মানুষ বেঈমানি করে কিন্তু কুকুর সেটা করে না।”
কুকুর- মানুষের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্হান শতাব্দি থেকে শতাব্দি জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্হাপন করে আসছে।
Post a Comment