হিটলারকেও মুগ্ধ করেন এই গুপ্তচর ! নতর্কীর রহস্যময় জীবন
Odd বাংলা ডেস্ক: নর্তকী হিসেবেই ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জন করে কাটিয়ে দিতে পারতেন নিশ্চিত জীবন। তবে এর মাঝে বাধ সাধলো তার দেশপ্রেম, তার জাতীয়তাবোধ। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হয়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কৌশলে তথ্য সংগ্রহ করেন। আর তা পাঠিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন জেনারেল রোমেলের কাছে। তবে বিনিময়ে তাকে ত্যাগ করতে হয়েছিল অভিনেত্রী হওয়ার বাসনা, করতে হয়েছিল কারাবরণ।
নাম তার হেকমাত ফাহমি। তিনি মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত নর্তকীদের মধ্যে একজন। তার জন্ম ১৯০৭ সালের ২৪ নভেম্বর মিশরের এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে। ছিলেন বিখ্যাত মিশরীয় অভিনেত্রী আজিজা আমিরের ভাতিঝি। তার স্বপ্ন ছিল একদিন তিনিও আন্টির মতো বড় অভিনেত্রী হবেন। তবে কথায় আছে না মানুষ যা চায় তা পায় না। আবার যা পায় তা চায় না। তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। অভিনেত্রী হতে গিয়ে তার ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে নর্তকী হিসেবে। তবে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন তিনি জড়িয়ে পড়েন এসপিওনাজের জগতে।
মঞ্চ অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে থিয়েটারে কাজ শুরু করলেও অভিনয়ের পরিবর্তে তার মধ্যে নাচের দক্ষতাই বেশি প্রকাশ পেতে থাকে। ফলে ১৯২৭ সালে তিনি থিয়েটার ছেড়ে যোগ দেন কায়রোর নিকটবর্তী গিজা শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি নাইট ক্লাবে। এটি ছিল তৎকালীন সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ, ব্রিটিশ সামরিক অফিসার, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং এসপিওনাজ জগতের সদস্যদের নিয়মিত আড্ডাখানা।
হেকমাত ধীরে ধীরে কায়রোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বেলি ড্যান্সার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেন। তার খ্যাতি সে সময়ের অন্যান্য বিখ্যাত সব নর্তকীকে ছাড়িয়ে যায়। এ সময় ক্যাসিনোতে আসা সমাজের উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিদের সঙ্গে এবং ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে হেকমাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এর ফলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি পড়ে যান ব্রিটিশ বিরোধী জার্মান গোয়েন্দাদের নজরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে অস্ট্রিয়া ভ্রমণকালে তিনি নিমন্ত্রণ পান স্বয়ং জার্মান চ্যান্সেলর হিটলারের কাছ থেকে। হিটলার এবং তার প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের সামনে তিনি নৃত্য পরিবেশন করেন। জীবিকার প্রয়োজনে নৃত্যশিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও, হেকমাত ছিলেন জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার অধিকারী। ফলে তার সহানুভূতি ছিল মিশর দখল করে রাখা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জার্মান বাহিনীর দিকে। এই সময় ব্রিটিশদের উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য জার্মানের জেনারেল রোমেল দায়িত্ব দেন জন এপলারকে।
আর ভাগ্যক্রমে এই জন এপলার ছিলেন হেকমাত ফাহমির বাল্যকালের বন্ধু। তার অনুরোধে হেকমাত জড়িয়ে পড়েন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম আলোচিত একটি গোয়েন্দা কার্যক্রমে। হেকমাত তার অধীনস্থ আরো কিছু বেলি ড্যান্সারকে গোয়েন্দা কার্যক্রমে নিযুক্ত করে গুপ্তচরদের এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ কর্মকর্তাদেরকে প্রায়ই তার বোটহাউজে নিয়ে যেতেন।
তারা উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদেরকে প্রলুব্ধ করতেন, মদ খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করিয়ে তাদের মুখ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করে তা হস্তান্তর করতেন এপলারের কাছে। প্রথম দিকে তারা বোটের গ্রামোফোন ক্যাবিনেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখা রেডিও ব্যবহার করে জার্মান গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলেও কিছুদিনের মধ্যেই রেডিওতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়।
এপলার এবং স্যান্ডস্টিন জার্মান রেডিও অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য কোডবুক হিসেবে ব্যবহার করতেন ড্যাফনে দু মরিয়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘রেবেকা’র ইংরেজি সংস্করণ। এপলাররা মিশরে প্রবেশ করার পরপরই দুজন জার্মান গোয়েন্দা রেবেকা বইটির একটি কপি সহ ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে যায়। ব্রিটিশরা বুঝতে পারে, এই বইয়ে থাকা শব্দগুলো ব্যবহার করে কেউ মিশর থেকে সাংকেতিক ভাষায় তথ্য পাচার করছে। তারা সেই গুপ্তচরের খোঁজে জোর অভিযান শুরু করে।
এই সময় তারা বোটহাউজটির উপর নজরদারি বাড়িয়ে দেন। তিনি দেখতে পান, যে সময়টিতে ম্যাসেজ পাঠানো হয়, ঠিক সে সময়েই এপলার এবং স্যান্ডস্টিন হেকমাতের বোটহাউজ থেকে নিজেদের বোটহাউজে ফেরত আসেন। ফলে স্যামসনের পক্ষে দুই দুইয়ে চার মেলাতে বেশি কষ্ট হয়নি। এর কয়েকদিন পর স্যামসনের গোয়েন্দারা যখন হেকমাতের অধীনস্থ এক ফিলিস্তিনী নর্তকীকে আটক করে এবং তার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে, তখন তারা নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারে, জন এপলারই সেই গুপ্তচর।
এই অবস্থায় তাকে হাতেনাতে আটক করার জন্য বোটে হামলা করলে। আর তখন এপলার তার পায়ের মোজা দলা পাকিয়ে গ্রেনেডের মতো করে ছুঁড়ে মারেন এবং সেই সুযোগে নীল নদে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তার আগেই তাকে আটক করে ফেলা হয়। ব্যর্থ হয় হেকমাত-এপলার জুটির অপারেশন কন্ডর। হেকমাত ফাহমিকে বন্দী অবস্থায় নির্যাতন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু তিনি সহজে সে বিষয়ে মুখ খোলেননি।
এপলারকে অবশ্য বেশিদিন বন্দী থাকতে হয়নি। আড়াই বছর কারাভোগের পর যখন হেকমাতকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তখন এপলার তাকে কায়রোতে একটি নাইটক্লাব কিনে দিয়েছিলেন।হেকমাত ফাহমি অবশ্য আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। তার বিখ্যাত অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। ১৯৭৪ সালে, ৬৭ বছর বয়সে অনেকটা নিভৃতেই মৃত্যুবরণ করেন হেকমাত। নিজের ইচ্ছেকে বলি দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও দেশের জন্য যে ভালোবাসা তিনি দেখিয়েছেন তা ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
Post a Comment