দুইটি বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী এই জাহাজ আজ ভুতুড়ে!
Odd বাংলা ডেস্ক: ভুতুড়ে এক জাহাজ। যে কেউ দেখলেই গা ছমছমে ভাব হবে! আমেরিকার ওহিও নদীর তীরে ছোট একটি খালে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে এই ভুতুড়ে জাহাজটি। চারটি স্কুল বাসের থেকেও বড় আকৃতির এই জাহাজটির সঙ্গে যদিও কোনো অলৌকিক বিষয় জড়িত নয় তবুও এটি ভুতুড়ে বলেই বিবেচিত।
এই জাহাজটি স্যাচেম নামেই পরিচিত। বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ নির্মাণের ১০ বছর পূর্বে ১৯০২ সালে স্যাচেম নির্মিত হয়েছিল। স্যাচেম জাহাজের খুবই আকর্ষণীয় ইতিহাস আছে। এটি দুটি বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, প্রখ্যাত মার্কিন উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন জাহাজটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। কয়েকটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে এই জাহাজটিকে কেন্দ্র করে। এমনকি একজন বিখ্যাত পপ তারকার মিউজিক ভিডিওতেও আছে জাহাজটি।
স্যাচেমের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯০১ সালের শেষের দিকে। এটি মূলত একটি স্টিম ইয়েট। সে সময়ের একটি বড় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পোসি অ্যান্ড জোনস এটি নির্মাণ করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ১৮৪৮ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল এবং ৫০০টিরও অধিক বিভিন্ন প্রকার জাহাজ নির্মাণ করেছে। ম্যানহ্যাটনের ধনী ব্যবসায়ী জন রজার্স ম্যাক্সওয়েল জাহাজটি নির্মাণের উদ্যোক্তা।
তিনি ১৯ শতকের শেষভাগে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একটি দ্বীপের দীর্ঘ উপকূল জুড়ে তার একটি অত্যাশ্চর্য ম্যানশন এবং উদ্যান ছিল। তিনি প্রথমে জাহাজটি সেল্ট নামে তৈরি করালেও পরবর্তীতে স্যাচেম নামকরণ করা হয়। স্টিম ইয়েটটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৮৬ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ২৪ ফুট।
সে সময়ের সবচেয়ে উন্নত যন্ত্রাংশ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজটি নির্মাণ করা হয়। এর নকশা প্রস্তুত করেছিলেন তৎকালীন খ্যাতিমান ইয়েট ডিজাইনার হেনরি সি উইন্ট্রিংহ্যাম। সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল মাত্র পাঁচ মাস। এই জাহাজটি সমুদ্রে ভেসেছিল ১৯০২ সালের ১২ই এপ্রিল। এর মালিক জন রজার্স ম্যক্সওয়েল প্রায় এক দশকে ইয়েটটি নিয়ে পুরো নিউইয়র্ক উপকূলরেখা ভ্রমণ করেছিলেন।
জন রজার্স এর সাহায্যে ইয়েট রেসিং প্রতিযোগিতায় কয়েকটি পুরস্কারও জিতেছিলেন। ১৯১০ সালে রজার্স মৃত্যুবরণ করলে এটি আর রেসিং ইয়েট হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। তার স্ত্রী ইয়েটটি নিউইর্কের ব্যবসায়ী ম্যান্টন ব্রাডলি মেটলাক সিনিয়রের কাছে বিক্রি করে দেন। তিনি এর নাম দেন স্যাচেম। ম্যান্টন এটি ব্যক্তিগত ইয়েট হিসেবেই ব্যবহার করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌ বাহিনী ব্যক্তিগত ইয়েট এবং জাহাজ সংগ্রহ শুরু করে। তখনকার ইয়েটগুলোর গতিও ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে মার্কিন নৌবাহিনী ইয়েটটি সংগ্রহ করে ইউএসএস স্যাচেম (এসপি ১৯২) নামকরণ করে।
মার্কিন নৌবাহিনী ইয়েটটি একটি আধুনিক সামরিক নৌযানে পরিণত করে। দুটি লাইট মেশিনগানসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সজ্জিত করেছিল ইয়েটটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে টহল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘এসপি’ পেট্রল ক্র্যাফট উপাধি পায় স্যাচেম। প্রখ্যাত মার্কিন উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই জার্মান ইউ-বোটের বিরুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য কাজ করছিলেন।
তিনি মূলত সাবমেরিন এবং টর্পেডো সনাক্তকরণ পদ্ধতি এবং শিপ ক্যামোফ্লেগিং পদ্ধতি বিকাশে সহায়তা করছিলেন। যে কারণে টমাস এডিসনের একটি ভাসমান পরীক্ষাগারের প্রয়োজন ছিল। তখন নৌবাহিনী তাকে ইউএসএস স্যাচেম জাহাজটি সরবরাহ করে। টমাস এডিসন স্যাচেম জাহাজেই ভাসমান পরীক্ষাগার স্থাপন করেন।
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মার্কিন নৌবাহিনী স্যাচেম ইয়েটটি তার মালিক ম্যান্টনকে ফিরিয়ে দেয়। ম্যান্টন পরবর্তী সময়ে রোল্যান্ড লেসলি টেইলর নামক এক ব্যক্তির কাছে সেটি বিক্রি করেন। নতুন মালিকের বিরুদ্ধে ইয়েটটি অবৈধ পণ্য পাচার করার কাজে ব্যবহারের অভিযোগ ছিল। যাই হোক, ১৯৩২ সালের মহামন্দার সময় টেইলর জাহাজটি বিক্রি করেছিলেন ক্যাপ্টেন জ্যাকবের কছে নাম মাত্র মূল্যে।
জ্যাকব জাহাজটি ফিশিং বোটে রূপান্তর করেন। তিনি জাহাজটিতে পরবর্তীতে অত্যাধুনিক ইঞ্জিন সংযুক্ত করেন।জাপানি সৈন্যরা ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবার আক্রমণ করলে মার্কিনরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই মার্কিন নৌবাহিনী পুনরায় অন্যান্য ব্যক্তিগত জাহাজের সঙ্গে স্যাচেম জাহাজটি সংগ্রহ করে।সামরিক নৌযানে পরিণত করে স্যাচেমের নতুন নাম দেয়া হয়েছিল ইউএসএস ফেনাকাইট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পুনরায় মালিকের নিকট ফেরত দেয়া হয় ইয়েটটি। দীর্ঘ সময় ধরে অসংখ্যবার হাত বদল, নাম এবং কাজের ধরণ বদলের পর স্যাচেম জাহাজটি ১৯৮৮ সাল থেকে ওহিও নদীর একটি ছোট খালে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। বর্তমানেও সেটি পরিত্যক্ত রয়েছে। কয়েকটি সিনেমার স্যুটিং হয়েছে জাহাজটিতে। এখন এটি ভুতুড়ে জাহাজ হিসেবেই পরিচিত। প্রতিনিয়ত জাহাজটি দেখতে পর্যটকদের ভিড় জমে।
Post a Comment