Odd বাংলা ডেস্ক: বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির লোকোমোটিভের কল্যাণে হাই স্পিড ট্রেন চলাচল দেখা যায়। কয়েকটি দেশে প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটারেরও বেশি গতির ট্রেন চলাচল করে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের পূর্বে কিংবা শুরুর দিকের লোকোমোটিভগুলোর এতটা গতি কল্পনাও করা যেত না। যন্ত্রচালিতও ছিল না সেগুলো। এমনকি প্রথম দিকে লোকোমোটিভ পরিচালনার জন্য পশু-প্রাণীর শক্তি ব্যবহারের চেষ্টাও করা হয়েছে। পশু-প্রাণীর শক্তি ব্যবহার করে গাড়ি টেনে নেয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বহুকাল আগে থেকেই এর প্রচলন ছিল। তবে গাড়ির ভেতরে ঘোড়া দৌড়াতো আর ম্যাজিকের মতো ঘুরতো চাকা এমন বাস্তবতা বেশ অবাক করা ঘটনাই ছিল।
বাষ্প চালিত লোকোমোটিভ মূলধারায় ব্যবহৃত হওয়ার আগে রেলপথ পরিবহন কেবলমাত্র পেশী শক্তি দ্বারা চালিত হতো। সাধারণত এক্ষেত্রে ঘোড়ারই ব্যবহার হতো বেশি। কাঠের বা লোহার তৈরি স্থির রেল ওয়াগনের উপরে খনি থেকে কয়লা এবং আকরিক পূর্ণ বাহন টেনে নিয়ে যেত ঘোড়া। এক পর্যায়ে এ ওয়াগনগুলো পুরো ইউরোপ জুড়ে প্রধান খনি থেকে কয়লা পরিবহনের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে।
১৮২৭ সালে সাউথ ক্যারোলিনা ক্যানাল অ্যান্ড রেলরোড কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনও বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের ব্যবহার পুরোপুরি শুরু হয়নি। কোম্পানিটি সে সময় যুতসই পরিবহন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করছিল। সে কারণেই সংস্থাটি ঘোড়া চালিত লোকোমোটিভগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালোটা বেছে নেয়ার জন্য একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেরা লোকোমোটিভের জন্য ৫০০ ডলার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল তারা।
এ প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে অদ্ভুত ডিজাইন বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টিয়ান এডওয়ার্ড ডেটমোল্ড এর নির্মাতা ছিলেন। ডেটমোল্ডের মডেলটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’। এ লোকোমোটিভের মাঝখানে একটি ক্যারেজ ছিল, যার কেন্দ্রে একটি ট্রেডমিল স্থাপন করা হয়। অবাক করা বিষয় হলো এ ট্রেডমিলের উপরেই ঘোড়া দৌড়াতো। আর এর দু'পাশে বেঞ্চ বাইরের দিকে মুখ করে স্থাপন করা হয়। ঘোড়া ট্রেডমিলের উপরে দৌড়ালে, উত্পাদিত শক্তি গিয়ারের স্থানান্তরিত হয়ে চাকা ঘুরতো এবং লোকোমোটিভ চলতে শুরু করতো। গিয়ার সিস্টেমটি ছিল সিরিজ আকারে কয়েকটি স্তরে বিভক্ত। ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’ ১৮৩০ সালে প্রথম রেলপথে চলা শুরু করে। এর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ছিল ১২ জন এবং প্রতি ঘণ্টায় ১২ মাইল গতিতে চলতে পারতো।
‘ফ্লাইং ডাচম্যান’র সাফল্য সত্ত্বেও চিফ ইঞ্জিনিয়ার হোরাতিও অ্যালেন রেলপথ পরিচালকদের বাষ্প চালিত লোকোমোটিভ ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, ঘোড়া থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতার পরিমাণ সীমিত। অন্যদিকে, একই সময়ে বাষ্প চালিত লোকোমোটিভ প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছিল। রেলপথ সংস্থার পরিচালকরাও হোরাতিও অ্যালেনের পরামর্শে একমত হয়েছিলেন।
এরপর রেলপথতে বাতাস চালিত বাহনের দ্বারা পরীক্ষা করা। ১৮৩০ সালের ১৯ মার্চ প্রথম পাল চালিত গাড়িটি ১৫ যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। প্রতি ঘণ্টায় ১৫ মাইল গতিতে চলতে সক্ষম হয়েছিল এটি। তবে বাতাস এত প্রবল ছিল যে মাস্তুল গাড়ির উপর থেকে উড়ে যায়। অবশেষে, ‘বেস্ট ফ্রেন্ড অব চার্লস্টন’ নামে একটি বাষ্প চালিত লোকোমোটিভ সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রতি ঘণ্টায় ৩০-৩৫ মাইল গতিতে ৪০-৫০ জন যাত্রী বহন করতে সক্ষম ছিল লোকোমোটিভটি। এটি সে সময়ের পরিবহনের অন্যতম দ্রুততম উপায় হিসাবে বিবেচিত হতো। তবে দুর্ঘটনাক্রমে এর বয়লার বিস্ফোরিত হয়। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছিল। দুর্ঘটনার পরে, রেলপথ সংস্থা অন্য বাষ্প চালিত ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন করে এবং আর কোনো ঘোড়া চালিত লোকোমোটিভ আনেনি। তবে এখানেই ঘোড়া চালিত লোকোমোটিভ তৈরির ঘটনা শেষ ছিল না।
১৮৫১ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে একটি প্রদর্শনীতে ইতালীয় প্রকৌশলী ক্লেমেন্ত মাসেরানো ‘ইমপালসোরিয়া’ নামে একটি ঘোড়া চালিত লোকোমোটিভ প্রদর্শন করেছিলেন। এ লোকোমোটিভে দুই জোড়ায় একটি ঝুঁকানো ট্রেডমিলের উপরে চারটি ঘোড়া দাঁড়াতে পারতো। এটি ধাতব ফ্রেমযুক্ত ছিল। এর পেছনের চাকা সামনের চাকাগুলো ছোট ছিল। ড্রাইভারের জায়গা ছিল পিছনের জোড়া ঘোড়াগুলোর কাছে। এ লোকোমোটিভে পিছনে আলাদা প্ল্যাটফর্ম ছিল। সেখানে আরেকজন চালক থাকতো, যে ব্রেকের কাজ করতো। এটি প্রতি ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ মাইল গতিতে চলতে সক্ষম ছিল। তবে ইমপালসোরিয়া কখনো ব্যবহৃত হয়নি। কারণ ততদিনে বাষ্প চালিত লোকোমোটিভে সফলতা অর্জিত হয়েছিল।
Post a Comment