ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ লাইনটির লেখক, ব্যর্থতাই যার সঙ্গী ছিল মৃত্যু পর্যন্ত

Odd বাংলা ডেস্ক: যারা সাহিত্যপ্রেমী আছেন তাদের কাছে একটি লাইন খুব পরিচিত। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখলেন, তিনি একটা আস্ত পোকা হয়ে গেছেন! এই লাইনটি চেনেন না কিন্তু গল্প উপন্যাসে ডুবে থাকে এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। কেননা এটি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন।

এটি আসলে একটি উপন্যাসের প্রথম লাইন। লাইনটি ছিল এরকম- একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখলেন, তিনি একটা আস্ত পোকা হয়ে গেছেন! অর্থাৎ তার রূপান্তর ঘটে গেছে। গ্রেগর সামসা একজন ট্রাভেলিং সেলসম্যান। এই উপন্যাসের এই প্রথম লাইনটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর অসংখ্য পাঠক এই একটি লাইনে যুগ যুগ ধরে ভাবনার খোরাক পেয়েছেন। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পর্যন্ত আন্দোলিত হয়েছিলেন এই একটি লাইন পড়ে। 


এই বাক্যের স্রষ্টার নাম ফ্রান্‌ৎস কাফকা। কাফকার এ উপন্যাসের বাকি অংশ পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে গ্রেগর সামসার মানিয়ে নেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টার কাহিনী। গ্রেগর তার দুর্বিষহ চাকরি জীবন নিয়ে বিপর্যস্ত, সে ভাবছিল তার এ পরিবর্তনটা বোধহয় একটা স্বপ্ন। কিন্তু যখন তার মা তাকে অফিসে যাওয়ার সময় পার হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলতে আসে, তিনি দরজায় কড়া নাড়ছেন- আর গ্রেগর তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে খেয়াল করল, সে পোকায় পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গলার স্বরও পাল্টে গেছে।


গ্রেগরের ছোট বোন গ্রেটাও দরজা খোলার জন্য তার ভাইকে ডাকছে, কিন্তু ভাই কোনো উত্তর দিতে পারছে না; এমনকি সে কোনোভাবে তার শরীরকেও নাড়াতে পারছে না। বাবা, মা, বোন এমনকি তার অফিসের ম্যানেজার কেউই দরজার ওপাশ থেকে গ্রেগরের কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে ভাবছে, সে সম্ভবত ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।


এভাবেই গ্রেগর সামসার জীবনে নতুন এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে 'মেটামরফসিস' উপন্যাসটি। মানুষ থেকে পোকায় পরিণত হয়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আশপাশের এমনকি নিকটজনদের কাছেই গ্রেগর সামসা হয়ে ওঠে একটা আতঙ্ক।


প্রাগ শহরে ১৮৮৩ সালে জন্মগ্রহণকারী বিশ্ববিখ্যাত লেখক ফ্রানৎস কাফকা 'মেটামরফসিস' উপন্যাসটি রচনা করেন ১৯১২ সালের দিকে। দু'বছর বাদে উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর জার্মান ভাষাভাষী পাঠকদের ছাড়িয়ে দ্রুত সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে কাফকার এ কালজয়ী উপন্যাসটি।


১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহা (প্রাগ) শহরের (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) এক মধ্যবিত্ত জার্মান-ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কাফকাকে বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এই জায়গায় পৌছানো মধ্যবিত্ত ঘরের একটি ছেলের জন্য এতটাও সহজ ছিল না। 

কাফকার বাবা ছিলেন হারমেইন কাফকা ছিলেন একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী। তার শুধুমাত্র একটি কাপড়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মা জুলি কাফকা ছিলেন গৃহিণী। তবে পাশাপাশি স্বামীর ব্যবসায় সাহায্য করতেন তিনি। হারমেইন ও জুলি পারিবারিক ব্যবসায় এতই ব্যস্ত থাকতেন যে তারা ছেলেমেয়েদের বিশেষ সময় দিতে পারতেন না। এ কারণে ফ্রান্‌ৎস কাফকার শৈশব একাকীত্বের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়।

বাবার সঙ্গে কাফকার সম্পর্কের তীব্র টানাপোড়ন ছিল। তার একাধিক লেখায় তার বাবার ছায়া নেমে এসেছে। তার 'ব্রিফ এন দেন ভেটার' বা 'বাবাকে লেখা চিঠি' থেকে জানা যায়, বাবাকে তিনি স্বৈরাচারী মনে করতেন। তবে তার মা ছিলেন নম্র ও শান্ত। শত অভাবেও কাফফার পড়ালেখা বন্ধ করেননি তারা।  বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শেষে ম্যাক্স ব্রড নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। যার সঙ্গে কাফকার আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। ম্যাক্স লক্ষ্য করেন, কাফকা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির এবং মিতভাষী। কাফকা আর ব্রড মিলে প্লেটো থেকে শুরু করে গুস্তাভ ফ্লবেয়ার পর্যন্ত নানা লেখা পড়েছেন, আলোচনা করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দস্তয়ভস্কি, ফ্লবেয়ার, ফ্রানৎস গ্রিলপারসার আর হাইনরিখ ফন ক্লাইস্ট-- এই চার লেখকের লেখা পড়ে কাফকা সবে চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে পাশ করে চাকরিতে ঢোকেন কাফকা। পাশাপাশি লেখালেখিও শুরু করেন। তার প্রথম কর্মস্থল ছিল এক ইতালিয়ান বিমা কোম্পানিতে। সেখানকার অভিজ্ঞতা কাফফার জন্য একেবারেই সুখের ছিল না। সকাল আটটা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে লেখালেখিতে সময় দিতে পারছিলেন না বলে চাকরিই ছেড়ে দিলেন। পরে চাকরি নিলেন একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে। যেটি ছিল ওয়ার্কার আক্সিডেন্ড ইন্সটিটিউড ফর দ্য কিংডম অব বহেমিয়া। দৈনিক ছ'ঘণ্টার চাকরি। সঙ্গে চলল লেখালেখি। ১৯০৮ সালে কাফকা তার প্রথম লেখা ছাপলেন।

১৯১৭ সালে কাফকার যক্ষ্মা ধরা পড়ল। ভয়ংকর ছোঁয়াচে এই রোগের চিকিৎসা তখনও তেমন না থাকায় নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন কাফকা। এই সময়েও লিখছেন আরেক মাস্টারপিস দ্য ট্রেইল প্রকাশিত হয়। যক্ষ্মার জন্য কাফকাকে চাকরি থেকে পেনশন দিয়ে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখনও লেখা চালিয়ে যান।

তবে ক্রমশ যেন কাফকা বিষাদে ডুবে যেতে লাগ্লেন। তার প্রেম-জীবনও মসৃণ ছিল না। মোটামুটি তিন জন প্রেমিকার কথা শোনা যায় তার পুরো জীবনে। কাফকার শেষ প্রেমিকার নাম ছিল ডোরা ডিয়ামান্ট। প্রত্যেককেই তিনি অসংখ্য চিঠি লেখেন। সেসবই অসাধারণ পত্রসাহিত্যের নজির হিসেবে রয়ে গেছে। ১৯২৩ সালে কাফকা যখন একটু একটু করে ফুরিয়ে আসছেন তখনই ডোরার সঙ্গে পরিচয়। দুজনে মিলে ঠিকও করলেন তারা প্যালেস্টাইন যাবেন, সংসার শুরু করবেন। রেস্টুরেন্ট খুলে ডোরা রান্না করবেন আর কাফকা হবেন ওয়েটার। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না তাদের। প্রেম ভেঙে গেল।  

একদিকে প্রেমে ব্যর্থ,  স্বল্প রোজগেরে ক্ষীণজীবী মানসিক ভাবে ভঙ্গুর ও বিষাদাচ্ছন্ন কাফকা বন্ধু ম্যাক্সকে এক আশ্চর্য চিঠি লিখলেন। প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স, আর হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়বে না। তাই তেমনভাবে লেখালেখিও করা হয়ে উঠছে না। আমার লেখাগুলোর ব্যাপারে তোমায় কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলো হয়তো কালস্রোতে হারিয়ে যাবে। আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলোর ব্যাপারে তোমায় বলছি, সব পাণ্ডুলিপি আর নোট পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলো সংগ্রহ করেও পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ যেন সেসব পড়ে না দেখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইল। তবে তুমি নিজে সে অনুরোধের বাইরে।   --ফ্রান্‌ৎস

বলাই বাহুল্য বন্ধুকে অত্যন্ত ভালোবাসলেও এক্ষেত্রে বন্ধুর কথা রাখেননি ম্যাক্স ব্রড। বরং তিনি নিজে সেসব লেখা পড়লেন। পড়ে বিস্মিত হলেন। আর যত্ন করে সেই সব লেখা প্রকাশ করলেন। জন্ম নিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জিনিয়াস এক গদ্যকার। নিজের অজান্তেই কাফকা জন্ম দিলেন নতুন এক ধারার। যার নাম ‘কাফকেস্কে’। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.