Odd বাংলা ডেস্ক: একবিংশ শতাব্দীতে এসে গানের জগতের অতীত ঘাটলে একটি নাম সামনে আসে জানকী বাই ইলাহাবাদি। বর্তমানে তাকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও বিশ্বে সংগীতে তার অবদান অসামান্য। ‘ছপ্পন ছুরিওয়ালি’ নামেও পরিচিত এই গায়িকা সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিশেষ করে যারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খবর রাখেন তাদের কাছে খুব পরিচিত এক নাম জানকী।
জানকীর ‘ছপ্পন ছুরিওয়ালি’ নামের পেছনে রয়েছে মর্মস্পর্শি এক কাহিনি। তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৮ শতকের শেষের দিকে। ১৮৮০ সাল, বারাণসীতে এক মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবারে জন্ম জানকীর। বাবা শিববালকরাম, মা মানকী, জানকীর আরও দুই বোন ও এক ভাই নিয়ে তাদের পরিবার। তার বাবা শিববালকরামের ছিল দুধের ব্যবসা এবং মিষ্টির দোকান। মা ছিলেন খুব শান্ত স্বভাবের। বাড়ির কাজেই তার দিন কাটত। ছোটবেলা থেকেই জানকীর ছিল গানের নেশা।
শিববালক ছিলেন কুস্তিগির। এক দিন ভোরে গঙ্গার ধারে আখড়ায় অনুশীলন করতে গিয়ে দেখতে পান, এক নারী সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। তাকে বাঁচান শিববালক। শিশুটি অবশ্য মারা যায়। সেই নারীকে বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি। গঙ্গা থেকে তুলে আনা নারীর নাম লক্ষ্মী। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন তিন সন্তানের বাবা শিববালক। এরপর শুরু হয় প্রথমা পত্নী মানকীর উপরে নির্যাতন। বালিকা জানকী তার বাবার এহেন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অন্য দিকে, লক্ষ্মীর সঙ্গে এক পুলিশ কনস্টেবলের প্রেম শুরু হয়। শিববালক ও মানকী বাড়িতে না থাকলে সেই কনস্টেবল রঘুনন্দন আসত। এক দিন লক্ষ্মী ও সেই ব্যক্তিকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে বালিকা জানকী। জানকীর মুখ চিরতরে বন্ধ করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে রঘুনন্দন। কিছু দিন পরে তাকে একা পেয়ে একটা ছুরি দিয়ে উন্মত্তের মতো কোপাতে থাকে সে। জানকী জ্ঞান হারালে সে পালিয়ে যায়।
গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান জানকী। জনশ্রুতি, তার শরীরে নাকি ৫৬টি আঘাতের দাগ ছিল। সেই থেকেই তিনি ‘ছপ্পন ছুরিওয়ালি’ নামে পরিচিত হতে শুরু করেন। এই ঘটনার পরে লক্ষ্মী বাড়ি থেকে গয়না ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। শিববালকও রহস্যময় ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। সন্তানদের নিয়ে মানকী পড়েন আতান্তরে। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে মানকীর। এমন সময়ে পার্বতী নামে এক নারীর কথায় বারাণসীর পাট চুকিয়ে সন্তানদের নিয়ে ইলাহাবাদে চলে আসেন তিনি। পার্বতী আসলে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। মানকীর ঠাঁই হয় শহরের নিষিদ্ধপল্লীতে।
এমন পরিবেশে মানকীর উপরে চরম দুর্যোগ নেমে এলেও জানকী কিন্তু তার স্বপ্নপূরণের সুযোগ পান। ইলাহাবাদের সেই পাড়াতেই তিনি প্রবেশ করেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুনিয়ায়। শুরু হয় তার সঙ্গীত শিক্ষা। বারাণসী থাকাকালীন জানকী কৈদল মহারাজ নামের এক সঙ্গীতজ্ঞের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। ইলাহাবাদে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান লখনউ ও গ্বালিয়রের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হস্সু খানকে। আর বাড়িতে চলতে থাকে ইংরেজি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা।
তালিম শেষ হলে বিভিন্ন আসরে গান গাইতে শুরু করেন জানকী। নজরে পড়েন সঙ্গীতজ্ঞ রামচন্দ্র দাসের। তার তারিফই জানকীকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক পেতে শুরু করেন জানকী। সমকালীন রীতি অনুসারে নাকি গলায় গান গাইতেন না জানকী। সেটাই তার সঙ্গীত জীবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।
সমকালের আর এক কিংবদন্তি গায়িকা গওহর জানের সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জানকীর। সেই সময় যখন মার্গ সঙ্গীতের নারী শিল্পীরা পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতেন, তখন এই দুই নারীর বন্ধুত্ব একটা বিশেষ উদাহরণ হয়ে ওঠে।
১৯১১ সালে সম্রাট পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষে আয়োজিত দিল্লি দরবারে জানকী ও গওহর জান একত্রে পরিবেশন করেন একটি বিশেষ গান ‘ইয়ে জলসা তাজপোশি কা মুবারক হো’। সাম্মানিক হিসেবে জানকী এবং গওহর, দু’জনকেই দেওয়া হয় ১০০টি করে সোনার গিনি।
১৯০৭ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি প্রথম রেকর্ড করে জানকী বাইয়ের গান। সেই সময় তার ২২টি গান রেকর্ড করা হয়েছিল। বিপুল জনপ্রিয়তা পায় সেই সব রেকর্ড। পরের বছর আরও ২৪টি গান ধরে রাখা হয় ডিস্কে। সেই সময় এই রেকর্ডিংয়ের জন্য জানকী পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৯০০ টাকা। ১৯১০-এ তার আরও ২২টি গান রেকর্ড করে গ্রামোফোন কোম্পানি। এ বার তিনি সাম্মানিক হিসেবে পান ১৮০০ টাকা।
সেই সময়ে গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে আসে ফরাসি রেকর্ড কোম্পানি ক্যাথে। সেখান থেকেও জানকীর বেশ কিছু রেকর্ড বার হয়। সেই সময়ে রেওয়াজ ছিল, শিল্পীদের সঙ্গে রেকর্ড কোম্পানিগুলির চুক্তিবদ্ধ হওয়ার। জানকী সেই বন্ধনে ধরা দেননি। ১৯১১ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে গ্রামোফোন কোম্পানি তার অসংখ্য গান রেকর্ড করে।
১৯২৮ সালে প্রথম আধুনিক প্রযুক্তিতে জানকীর গান ধরে রাখা হয়। গানের শেষে সেকালের রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি বলতেন, “মাই নেম ইজ জানকী বাই ইলাহাবাদী।” শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রায় সব শাখাতেই ছিল তার অনায়াস বিচরণ। ঠুমরি, দাদরা, চৈতি, হোরি, কাজরি, ভজন— সব রকমের গানেই তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় রাখতেন।
রাগ দরবারি কানাড়া, ভৈরবী, মল্লার, তিলক কামোদ, আশাবরী ইত্যাদিতে তার গাওয়া ঠুমরিগুলো আজও সমঝদারের তারিফ আদায় করে নেয়। আজও ইউটিউবে ‘মর যায়েঙ্গে পর ইশ্ককা চর্চা না করেঙ্গে’, ‘সইয়াঁ নিকল গয়ে ম্যায় না লড়ি থি’, ‘রসিলি তোরি আঁখিয়া’ ইত্যাদির শ্রোতার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
উর্দু ভাষায় জানকীর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এই ভাষায় তিনি কবিতা লিখতেন। ‘দিওয়ান-এ-জানকী’ নামে এক কাব্য সংকলনও প্রকাশিত হয় সেই সব কবিতা নিয়ে। সমকালীন কবি আকবর ইলাহাবাদীর স্নেহ তিনি পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, আকবর ইলাহাবাদী চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তার গজল ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা’-র জন্য।
দুই হাতে উপার্জন করেছেন জানকী বাই। এক সময়ে কোনো আসরে গান গাওয়ার জন্য দুই হাজার টাকা নিতেন। পরে তা দাঁড়ায় পাঁচ হাজারে। সেসময় আর কাউকে এতো টাকা সম্মানি দেওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারতেন না। জানকী বাইকে নিতে পাঁচ হাজার টাকা আয়োজকদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি ও ভূ-সম্পত্তি কিনেছিলেন জানকী। থাকতেনও বিলাসবহুল কেতায়।
তার খ্যাতি যখন তুঙ্গে, তখনই ইলাহাবাদের এক আইনজীবী আব্দুল হকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। কিন্তু বেশি দিন টেকেনি সেই সম্পর্ক। সারা জীবন দারিদ্র ও আর্তের সেবা করে গিয়েছেন জানকী। গড়ে তুলেছিলেন ‘জানকীবাই ট্রাস্ট’। সেখান থেকে গরিব ও মেধাবি শিক্ষার্থীদের অর্থ সাহায্য করা হত, গরিব মানুষকে খাদ্য ও বস্ত্র দান করা হত। বেশ কিছু মন্দির ও মসজিদেও দান করতেন জানকী। আজও সেই ট্রাস্ট কাজ করে চলেছে একই ধারায়।
জীবনের শেষ পর্ব নিঃসঙ্গ কেটেছে এই কিংবদন্তি শিল্পীর। শিষ্য মহেশচন্দ্র ব্যাস তার দেখাশোনা করতেন। ১৯৩৪ সালে মারা যান জানকী বাই। পতন একটি নক্ষত্রের। মহেশচন্দ্রের উদ্যোগেই তাকে ইলাহাবাদের এক গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়। ট্রাস্ট সেখানে পরে একটি সৌধ স্থাপন করে।
২০১৮ সালে লেখিকা নীলম শরণ গৌর ‘রিকুইম ইন রাগা জানকী’ নামে এক গ্রন্থে এই শিল্পীর জীবনের খুঁটিনাটি বিবরণকে তুলে আনেন। এই বই জানকীর জীবন অবলম্বনে লেখা এক উপন্যাস। সেখানে জানকীর শিল্পী হয়ে ওঠার সঙ্গে মিশে রয়েছে ভারতে গ্রামোফোন কোম্পানির উত্থান আর সেকালের ইলাহাবাদ শহরের অনাবিল বর্ণনা।
Post a Comment