কাউকে গালি দেয়ার পর আত্মতৃপ্তি কেন পাই আমরা?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: সারাদিন বিভিন্ন কাজের জন্য অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কারোর কোনো ভুল দেখলেই তাকে বকাবকি শুরু করেন অনেকে। অফিসের বস যেমন আপনার কাজের ভুলের কারণে গালি দিচ্ছে। আপনি বাইরে বেরিয়ে হয়তো কিছু টাকা কমবেশির জন্য রিকশাওয়ালাকে একপ্রস্ত গালি দিলেন। 

অনেক সময় সবচেয়ে নম্র-ভদ্র লোকটির মুখ থেকেও বেরিয়ে আসে একটা গালি। এটা প্রায় মানুষের রিফ্লেক্স বা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মতই হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছেন, একটা অশিষ্ট গালি দিয়ে আমরা এত আরাম বোধ করি কেন? গালির পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। এটি নিয়ে বিবিসির একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। চলুন জেনে নেয়া যাক-  


মানুষ গালি দিয়ে আরাম পায়, কিন্তু কেন? এটা কি আমরা জেনে বুঝেই করি, নাকি আমরা যখন অশিষ্ট ভাষা ব্যবহার করি তখন আমাদের মস্তিষ্কে এবং দেহে সত্যি কিছু একটা পরিবর্তন হয়?


আমাদের সবার ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে। আমরা হোঁচট খেয়ে পায়ের আঙুলে ব্যথা পেলাম, বা রাস্তায় আপনার গাড়িকে আচমকা বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করে চলে গেল আরেকটা গাড়ি, অথবা কাপ থেকে হঠাৎ পড়ে গেল কফি, বারোটা বেজে গেল মেঝের। সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আপনার মন মতো একটা গালি।


এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা প্রায় সহজাত প্রবৃত্তির মতই বেছে নিই একটা বা একগুচ্ছ অশ্লীল শব্দ, আর সেগুলো মুখ দিয়ে উগরে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই - প্রায় যাদুমন্ত্রের মতই - আমরা তাৎক্ষণিক একটা আরাম বোধ করি। কেউ বেশি গালাগালি করে, কেউ বা কম। আবার অতিমাত্রায় খুশি হলে গালি দেয়, এমন লোকও আছেন।


সব ভাষায়, সব সংস্কৃতিতেই মানুষ গালি দেয়। হয়তো এমনও হতে পারে যে অন্য প্রাণীরাও গালি দেয়, শুধু মানুষই নয়। গালি দেবার প্রবণতার পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলো কী? 


গালির সংজ্ঞা কী?

গালি জিনিসটা আসলে ঠিক কি, তা নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা খুব কঠিন। এমনটা বলছিলেন গালি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ড. এমা বার্ন। তিনি একটি বই লিখেছেন যার শিরোনাম "সোয়ারিং ইজ গুড ফর ইউ" - অর্থাৎ 'গালি দেয়া আপনার জন্য ভালো!' তার মতে, গালি হচ্ছে এমন এক ধরনের ভাষা যা আমরা চমকিত বা স্তম্ভিত বা উৎফুল্ল হলে ব্যবহার করি, অথবা ব্যবহার করি মজা করার জন্য বা কারো প্রতি আক্রমণাত্মক হবার জন্য। তবে এটা এমন একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার যা শুধু একটা জনগোষ্ঠী, ভাষা, সমাজ, দেশ বা ধর্মের মধ্যেই অর্থপূর্ণ হতে পারে। 


তিনি বলছেন, প্রকৃতপক্ষে কোন শব্দটা একটা গালি হয়ে উঠবে তা আমরা সবাই মিলেই ঠিক করি। আর সেটা হয় অনেকটা এইভাবে - আমরা সবাই একমত হই যে কোন একটা বিশেষ সংস্কৃতিতে কোন জিনিসগুলো 'ট্যাবু' (যা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা হয় না)। কোনো সমাজ হয়তো দেহের কোন বিশেষ অংশের উল্লেখে লজ্জা-অপমান বোধ করে, কারো ক্ষেত্রে এটা হতে পারে কোন প্রাণীর নাম, কারো ক্ষেত্রে হয়তো কোন অসুখ বা রোগ, কারো বেলায় কোন বিশেষ শারীরিক ক্রিয়া।


তবে সব গালির ক্ষেত্রেই একটা বিশেষ দিক আছে যা এর ''কার্যকারিতার জন্য'' খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা গালি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানসিক অভিঘাত সৃষ্টির জন্য আপনাকে অবশ্যই সেই বিশেষ সমাজের কোনো একটা নিষিদ্ধ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করতে হবে। গালি হচ্ছে সেই ধরনের ভাষা - যা আপনি কিছু কিছু পরিস্থিতিতে কখনোই ব্যবহার করবেন না, যেমন কোন চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময়, বা আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকার বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়।


তাহলে আমরা গালি দেই কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই অনেক কথা বলবেন হয়তো। একজন বলছিলেন, খুব চাপের মধ্যে আছি এমন পরিস্থিতিতে - বা যখন অপ্রত্যাশিত কিছু একটা ঘটে, তখন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মতই একটা গালি বেরিয়ে আসে। আর তখন কেমন করে যেন ভালোও লাগে। যখন সে কাউকে গালি দিচ্ছে, সেটা একটা আনন্দ, চরম বিস্ময়, বা গভীর দুঃখ, বেদনা, বা ক্রোধ- যে কোনো রকম পরিস্থিতিতেই হতে পারে।  


এমন লোকও নিশ্চয়ই আছেন যারা কখনোই গালি দেন না। তবে এই শ্রোতারা যা বলছেন - তা হয়তো আমাদের অনেকের সঙ্গেই মিলে যাবে। বিশেষ করে মুখ থেকে খারাপ ভাষা ছুঁড়ে দেবার অনুভূতি - এমন কিছু শব্দ, যাতে একটা অতিরিক্ত শক্তি ভরা থাকে বলে অনেকেই মনে করেন।


ড. বার্ন বলছেন, তার গবেষণার সময় যে বিষয়গুলো সবচেয়ে আগ্রহ-উদ্দীপক বলে মনে হয়েছে তার একটা হলো - যে মানুষদের হেমিস্ফিয়ারেকটমি বলে এক ধরণের মস্তিষ্কের অপারেশন হয়েছে - তারা কথা বলার ক্ষমতা অনেকটা হারিয়ে ফেললেও গালি দেবার ক্ষমতা রয়ে যায়।


হেমিস্ফিয়ারেকটমি হচ্ছে এমন একটা অস্ত্রোপচার যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি অংশ অপসারণ করা হয়। দেখা গেছে, কারো হয়তো মস্তিষ্কের বাম দিকের অংশ কেটে বাদ দেয়া হয়েছে, বা স্ট্রোকের মত কোন কারণে মস্তিষ্কের বাম দিক গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে - তার ফলে সে হয়তো কথা বলার ক্ষমতা বা ভাষার অনেকটাই হারিয়ে ফেলে, কিন্তু তখনো সে গালি দিতে পারে।


এতে মনে হয়, কিছু ধরনের কথার সঙ্গে আমাদের আবেগের খুব জোরালো সম্পর্ক আছে এবং সেগুলো আমাদের মস্তিষ্কের ভিন্ন কোনো একটি জায়গায় জমা থাকে। সেকারণেই মস্তিষ্কের কিছু অংশ কেটে বাদ দিলে তার সাধারণ ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা কমে যায়, কিন্তু স্বত:স্ফূর্তভাবে গালি দেবার ক্ষমতাটা ঠিকই রয়ে যায়।


গালি দেয়াটা অনেকটা আবেগের সঙ্গে এত গভীরভাবে সম্পর্কিত যে ওই শব্দগুলো উচ্চারণের জন্য যে মাংসপেশীর নড়াচড়ার দরকার হয়, তা একাধিক জায়গায় ধারণ করা থাকে। যাতে দরকার মতো ব্যবহারের জন্য 'ব্যাকআপ' থাকে। 


কীল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচারার  ড. রিচার্ড স্টিভেন্স এর মতে, যন্ত্রণার লাঘব করতে কি গালি সহায়ক হয়। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা "গালি ল্যাবরেটরি" আছে যেখানে তারা এ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তাদের একটি পরীক্ষা আছে যাতে দেখা হয় কোন চরম পরিস্থিতিতে বা ব্যথা-যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষেত্রে গালি দেয়াটা সহায়ক হয় কিনা।


পরীক্ষাটা হলো, বরফ ভর্তি একটা বালতিতে হাত ডুবিয়ে রাখা এবং দেখা কতক্ষণ পর্যন্ত একজন এটা সহ্য করতে পারে। একজন ব্যক্তিকে নিয়ে দু'বার পরীক্ষাটা করা হয়। একবার তিনি গালাগালি দিতে থাকবেন, আরেকবার ভদ্র ভাষা ব্যবহার করবেন।


বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, যখন পরীক্ষাধীন ব্যক্তিটি গালি দিচ্ছেন তখন তিনি দীর্ঘতর সময় বরফে হাত ডুবিয়ে রাখতে পারছেন এবং ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সহ্য করতে পারছেন। কিন্তু যখন তিনি ভদ্র বিকল্প শব্দ ব্যবহার করছেন তখন তার সমস্যা হচ্ছে - কারণ ওই শব্দগুলো তার আবেগের ওপর সেই প্রভাব ফেলতে পারছে না, যা গালিসূচক শব্দগুলো পারছে।


এর কারণ কি?

সাধারণ শব্দ ব্যবহারের তুলনায় গালি দেবার সময় মানুষের হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে যায় বলে আমরা দেখেছি। আমরা জানিয়ে যে গালিটা এক ধরনের আবেগপূর্ণ ভাষা, এবং এরকম ভাষায় কথা বলার সময় একধরনের আবেগগত প্রতিক্রিয়া হয় মনে আভাস পাওয়া যাচ্ছে," - বলছেন ড. স্টিভেন্স।


সে কারণে আমরা অনুমান করছি যে যখন মানুষ বেদনাহত হয়ে গালাগালি করে - তখন তারা আসলে তাদের স্ট্রেস বা মানসিক চাপের স্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এর মধ্যে থেকেই এমন একটা প্রক্রিয়া ঘটছে যাতে তার ব্যথার অনুভূতি অসাড় হয়ে যাচ্ছে - যাকে বলা হয় 'স্ট্রেস ইনডিউসড এ্যানালজেসিয়া' - এবং এটা 'যুদ্ধ করো অথবা পালাও' এ জাতীয় বৃহত্তর প্রতিক্রিয়ার অংশ, বলেন ড. স্টিভেন্স।


বিভিন্ন ভাষায় গালাগালি

এতক্ষণের আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায় যে, সব সংস্কৃতিতেই গালি দেবার পর একই অনুভূতি হয়। পৃথিবীর সব ভাষাতেই কমবেশি গালির ভান্ডার আছে। স্প্যানিশ ভাষা গালাগালির জন্য খুবই সৃষ্টিশীল এক ভাষা। যখন কেউ ভীষণ রেগে যায়, তখন আপনি শুনবেন সে পুরো বাক্য বলছে, যা বর্ণনা করছে তাতে কর্তা-কর্ম-ক্রিয়াপদ সবই আছে - কিন্তু তার সবগুলো শব্দই আসলে গালি। 


মল্টায় সবচাইতে অপমানজনক শব্দ বা গালির অর্থ হচ্ছে,"বীর্য"। রুশ ভাষা হচ্ছে গালি দেবার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ভাষা। এ ভাষায় প্রায় যে কোনো কিছুকেই অশিষ্ট বানানো যায়। গালাগালির সংস্কৃতি আমাদের সাহিত্যের গভীরে প্রোথিত। ম্যান্ডারিন চীনা ভাষায় কিছু মজার গালাগালি আছে। যার অর্থ হচ্ছে আপনার ১৮ প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষদের প্রতি খারাপ কিছু করা। আরেকটা চীনা গালি আছে যা কচ্ছপের ডিমের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা তৈরি হয়েছে এই ধারণা থেকে যে মা-কচ্ছপদের বহু প্রেমিক থাকে।


কাজেই দেখা যাচ্ছে যে গালির বিষয়বস্তু নানা দেশে নানা রকম হতে পারে, কিন্তু গালাগালিটা যে মানুষের সংস্কৃতির একটা বৈশ্বিক দিক - তা বেশ স্পষ্ট। এদিক থেকে প্রাণীরাও পিছিয়ে নেই। 


ড. এমা বার্ন বলছেন, শিম্পাঞ্জীদের নিয়ে কিছু দারুণ সমীক্ষা হয়েছে - যাতে কিছু শিম্পাঞ্জীকে লালনপালন করা হয়, এবং পারিবারিক পরিবেশে রাখা হয়। আমেরিকান প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ ডেবোরা ও রজার ফুটস এই শিম্পাঞ্জীদের চারপাশে থাকতেন এবং তারা তাদের সামনে শুধু হাত-মুখের ইশারার ভাষায় কথা বলতেন।


এভাবে তারা শিম্পাঞ্জীদের সবকিছুর জন্য ইশারা-ইঙ্গিতের ভাষা শিখিয়ে দেন। বন্য পরিবেশে শিম্পাঞ্জীরা প্রায়ই নিজেদের বিষ্ঠা নিক্ষেপ করে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু ফুটস ওই শিম্পাঞ্জীদের বিষ্ঠাকে একটি নিষিদ্ধ জিনিস হিসেবে শিক্ষা দেন এবং তাদের মানুষের মত বাড়ির একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মলত্যাগ করার প্রশিক্ষণ দেন।


তারা এটা করার পর শিম্পাঞ্জীরা মলত্যাগ সংক্রান্ত ইশারার ভাষাও ব্যবহার করতে শিখে যায়। পরে দেখা যায়, যারা এই ব্যাপারটি আয়ত্ত করতে পেরেছে তারা অন্য শিম্পাঞ্জীদের ইশারার ভাষায় ''নোংরা বানর'' বলতো। যা ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে খারাপ অপমানসূচক সম্বোধন।


তাদের দেখা যেতো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তারা চিবুকের নিচে জোরে জোরে আঘাত করতে - ইশারার ভাষায় যার অর্থ নোংরা। অর্থাৎ বোঝা যায় প্রাণীরাও একে অন্যকে ছোট করতে কিংবা অপমান করতে ছাড়ে না। এরপর তাদের আত্মতৃপ্তিও হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.