নেদারল্যান্ডস: যে দেশে জনসংখ্যার চেয়েও বেশি সাইকেল চলে রাস্তায়

 


ODD বাংলা ডেস্ক: বর্তমানে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন এবং গতিশীল যান্ত্রিক সমাজে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস দিতে পারে যেন দু’চাকার সাইকেল। পৃথিবীর অনেক আধুনিক দেশ বর্তমানে এই বাহনটিকে বেশ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। সাইকেল শুধুমাত্র নগরায়নের প্রশান্তি নয়, সাইকেল চালকের স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিচারেও এর ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে, ছোট থেকে বৃদ্ধ সবাইই সাইকেল চালিয়ে তাদের নিত্যদিনের কাজ সম্পন্ন করছেন। আজ আমরা তেমন একটি শহরের কথা জানব, যেখানে তেল পোড়ানো যানের চাইতে সাইকেল নামক দ্বি-যানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে অনেক বেশি।

তেমনই একটি দেশ নেদারল্যান্ডস। ওই দেশের যেখানেই যাবেন সেখানেই দেখতে পাবেন সাইকেল আর সাইকেল। সেখানকার মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ থেকে শুরু করে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ও সাইকেল কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে নেদারল্যান্ডসে নাকি ২২ মিলিয়নের মতো সাইকেল রয়েছে। যেখানে দেশের জনসংখ্যাই মাত্র ১৭ মিলিয়ন। অর্থাৎ সেখানে যত না মানুষ তার চেয়েও অনেক বেশি সাইকেল।


আর এই বিশাল সংখ্যক সাইকেল সামাল দিতে রয়েছে সেখানে আলাদা রাস্তায় রয়েছে, ট্রাফিক ব্যবস্থা,  টানেল, ব্রিজ এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাইকেল প্যাকিং গ্যারেজ। এতকিছুর পরেও নেদারল্যান্ডসকে সাইকেলে দেশ না বললে ভুল হবে। তবে হঠাৎ করে এমনটা কিন্তু হয়নি। আর সাইকেলের দেশ হয়ে ওঠার গল্প যে সব সময় এক ছিল তা কিন্তু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের চল মোটামুটি ভালোভাবেই ছিল। এখনকার মতো এতটা প্রসার ও অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকলেও তখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সাইকেল চালাত। গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেলও দেখা যেত যথেষ্ট। তবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। তারপর পরিবর্তিত হতে থাকে দৃশ্যপট। দিন দিন কমতে থাকে সাইকেল আর বাড়তে থাকে গাড়ি।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিটি দেশই পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। নেদারল্যান্ডসও তার ব্যতিক্রম নয়। ঠিক এ সময়েই সাইকেলের জায়গা নিতে শুরু করে গাড়ি। তাই তারা যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গাড়িকে প্রাধান্য দিতে থাকে। এই প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গে নীতি নির্ধারকরাও যেন গাড়ি-কেন্দ্রিক শহরায়নের দিকে মন দিলেন। যেহেতু নেদারল্যান্ডসে আগে এত গাড়ি ছিল না, তাই রাস্তাগুলোও অতটা প্রশস্ত ছিল না।


গাড়ি চলার সুবিধার্থেই আগের রাস্তাগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হয়। এ কাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও নিদর্শন ভাঙা হয়। এই সবকিছুর ফলাফল হিসেবে গাড়ির সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়, আর সাইকেল যেন আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে যেতে থাকে। এর নেতিবাচক দিক সামনে আসে ১৯৭১ সালে এসে। সে সময় দেখা যায়, গাড়ির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনার হার। তখনকার পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে তিন হাজার জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়, যার মধ্যে ৪০০ জনেরও বেশি ছিল শিশু। এই মৃত্যুহার, বিশেষ করে শিশুমৃত্যু মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সূচনা হয় 'স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড' আন্দোলনের।


স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড- শিশুহত্যা বন্ধ করুন। মূলত ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলন। আর এর লক্ষ্যই ছিল গাড়ি দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যায় বিভিন্ন আরব দেশের। এই যুদ্ধে আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডস ও সমর্থন দেয় ইসরাইলকে। ফলাফল অনুমিত। আরব দেশগুলো নেদারল্যান্ডসসহ সে সব দেশের প্রতি রুষ্ট হয়। যেহেতু তাদের হাতে সারা বিশ্বের তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তাই তারা শাস্তিস্বরূপ ওই দেশগুলোতে তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে নেদারল্যান্ডসে তেল সংকট দেখা দেয়।


এমন অবস্থায় দুটো পথ খোলা ছিল নেদারল্যান্ডসের সামনে। হয় তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাও, নয় তেলের অভাবে মরো। কোনো সন্দেহ নেই আপনি যদি রাস্তায় গাড়ি চালু রাখতে চান তাহলে আপনার তেল লাগবে। তবে নেদারল্যান্ডসের সামনে তখন তেল ছাড়া যেন সবকিছুই আছে। তাই তারা প্রথম বিকল্প অর্থাৎ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিল।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যখন নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের যথেষ্ট প্রসার ছিল, তখন এটা বলতে গেলে নিয়মিত ঘটনাই ছিল। মাঝের সময়ে তা হারিয়ে যায়। তবে তেল সংকটের ওই সময়ে নেদারল্যান্ডসের জন্য এ ধারণার বিকল্প আর কিছু ছিল না। তাই দেশটি ১৯৭৩ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি 'কার ফ্রি সানডে' পালন করে। যেহেতু গাড়ি বন্ধ থাকবে, তাই বিকল্প কিছু খুঁজতে হবে। সেই বিকল্প হিসেবেই সাইকেল ফিরে আসতে শুরু করে।


১৯৭২ সালে শুরু হওয়া স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড আন্দোলন আর ১৯৭৩ সালের তেল সংকট- দুইয়ে মিলে অবশেষে সাইকেল ফিরে আসে নেদারল্যান্ডসে। সেজন্যই ধীরে ধীরে নির্মাণ করা হতে থাকে সাইকেল-বান্ধব বিভিন্ন অবকাঠামো, রাস্তাগুলো হতে শুরু করে সাইকেল-বান্ধব আর সাইকেলের বিক্রিও যায় বেড়ে। মানুষ আবার সাইকেলকে নিজেদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বরণ করে নেয়। এভাবেই নেদারল্যান্ডস হয়ে উঠতে শুরু করে সাইকেলের দেশ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.