ধানের ইতিকথা : বিবর্তন থেকে বিস্তার

 


ODD বাংলা ডেস্ক:  ধান মানব সমাজে অতি পরিচিত একটি কৃষিজাত পণ্য। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তার ঘটেছে ধানেরও। মানুষ তার নিজের নিয়ন্ত্রনে এনেছে ধান চাষের কতই না রীতি। এ ফসলটি আবাদী ফসলে পরিণত হয় আজ থেকে প্রায় ১৪ হাজার বছর আগে। ওরাইজা রুফিপোগন নামে এক প্রকার জংলি ঘাস প্রজাতি থেকে এর উদ্ভব। চলুন, আজ জেনে নেই ধানের বিবর্তন থেকে বর্তমানের বিস্তার পর্যন্ত কিছু ইতিকথা।

বর্তমান বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এশিয়ার সব ধানের প্রকরণ চাষযোগ্য হয়ে ওঠে প্রায় আট হাজার ২০০ থেকে ১৩ হাজার ৫০০ বছর আগে চীনের পার্ল রিভার ভ্যালি অঞ্চলে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, চীনের মধ্য ইয়াংজি নদী এবং হুয়াই নদীর উপরিভাগের তীরেই ওরাইজা স্যাটিভার চাষ শুরু হয়। এসব অঞ্চলে প্রায় আট হাজার বছর আগের ধানের কিংবা চাষের যন্ত্রপাতির নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। যা পরবর্তী দুই হাজার বছরে এর আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।


এরপর পশ্চিম ভারত কিংবা আরো দক্ষিণে শ্রীলঙ্কায় ধান খুব দ্রুতই বিস্তার ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকেই ধান শ্রীলংকায় প্রধান ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। এরপর গ্রীস এবং তার আশেপাশের অন্যান্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৪-৩২৪ অব্দে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত অভিযানের অভিযাত্রিরা ধানের প্রচলন ঘটায়। গ্রীস ও সিসিলি অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে ধান দক্ষিণ ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার অল্প কিছু জায়গায় বিস্তার লাভ করে।


ইউরোপের অভিযাত্রীরা এরপর যখন নতুন নতুন মহাদেশ আবিষ্কার শুরু করে, তাদের আবিষ্কৃত নতুন বিশ্বে ধান বিস্তার লাভ করে। পর্তুগিজরা ব্রাজিলে এবং স্প্যানিশরা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ওরাইজা স্যাটিভার প্রচলন শুরু করে। ১৬৮৫ সালে সর্বপ্রথম উত্তর আমেরিকায় ধান চাষ শুরু হয় উপকূলীয় নিচু জমি এবং দ্বীপসমূহে। এ অঞ্চল বর্তমানে দক্ষিণ ক্যারোলাইনা নামে পরিচিত। মনে করা হয়, আঠারো শতকের মধ্যভাগে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা দাসেরাই ক্যারোলাইনাতে ধান চাষের জটিল পদ্ধতির প্রচলন ঘটায়। দাসদের পরিশ্রমেই ধানের ফলন ক্রমাগত অব্যহত থাকে। ২০ শতকের মধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রোমেন্টো ভ্যালিতে ধান চাষ ছড়িয়ে পড়ে। ক্যালিফোর্নিয়ায় যে সময়ে ধান চাষ শুরু হয়, সেই সময়েই অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে ধানের সফল প্রচলন শুরু হয়।


ধানের আদি উৎপত্তিস্থল এশিয়া মহাদেশ হলেও, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় স্বাধীনভাবেই ধানের ভিন্ন দুটি প্রজাতির ডমিস্টিকেশন হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ফলনের দিক থেকে ওরাইজা স্যাটিভা এগিয়ে থাকায় সারাবিশ্বে এরই প্রচলন ঘটে।


এশীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ধান তথা ওরাইজা স্যাটিভার উপর ভর করে। এই ফসল, যেটি বর্তমানে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের প্রধান খাদ্য, একসময় মানুষকে যাযাবর শিকারি-সংগ্রাহক থেকে বাড়িতে থাকা কৃষকে পরিণত করে। প্রথম শহুরে মানুষ কিংবা সাম্রাজ্য ও রাজবংশ- সবই গড়ে উঠেছিল এই ফসলের চাষকে কেন্দ্র করে।


ধানের অধিক গুরুত্বের কারণেই এর ইতিহাস নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তবুও এশিয়ায় এর প্রথম উৎপত্তি এবং উদ্ভবের সময় নিয়ে বর্তমানে সবাই প্রায় একমত হতে পেরেছে।


ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ধানের অস্তিত্বের সন্ধান মেলে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০-৬০০০ সালে ইন্দো-গাঙ্গেও সমভূমিতে। যদিও অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতায় ধানের প্রচলন প্রথম শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দে। এখনও আসাম ও নেপালে তারই ধারাবাহিকতায় বহুবর্ষজীবী ধানের চাষ করা হয়। দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সালে উত্তর ভারতের পরে ধানের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আরও পশ্চিমে ধান চাষ এবং রান্নার পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।


আফ্রিকান ধান প্রায় তিন হাজার ৫০০ বছর ধরে চাষ করা হচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৮০০ অব্দে ওরাইজা গ্লাবেরিমা নামক আফ্রিকান প্রজাতি নিগার নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে চাষাবাদ শুরু হয়। এবং ধীরে ধীরে সেনেগাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এটি এর মূল অঞ্চল থেকে খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েনি। এমনকি এশিয়ান ধানের পূর্ব আফ্রিকায় প্রচলন শুরু হওয়ার পরে আফ্রিকান ধানের চাষাবাদ কমে যেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে পশ্চিম আফ্রিকায় এশিয়ান ধান ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকান ধান আফ্রিকার মানুষকে ১২০৩ সালের দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করেছিল।


দক্ষিণ আমেরিকায় ধান চাষের উদ্ভব হয় আজ থেকে ছয় হাজার থেকে চার হাজার বছর আগে। মন্টে ক্যাস্টেলোতে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির জন্য নিচু ভূমি বৃদ্ধি পাওয়া এবং বার্ষিক বন্যা বেড়ে যাওয়াই ছিল কারণ। এ ধরনের পরিবেশে অন্যান্য ফসলের তুলনায় ধানের ফলন বেশি হয়। ফলে সে সময়ের কৃষকরা বুনো ধানের চাষ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ধানের ডমেস্টিকেশন ঘটতে থাকে। যদিও তারা তখন ভুট্টার মতো অন্যান্য ফসলও ফলাত।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.